Subrata Mukherjee: জরুরি অবস্থা, সিদ্ধার্থ থেকে মমতা মন্ত্রিসভার বর্ণময় সুব্রত মুখোপাধ্যায়

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: রাজ্যে বাম জমানার পতনের পর যখন তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার মহাকরণে ঢুকছে, তখন প্রায় অনুচ্চারিত একটি নজির গড়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনিই মু়খ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: রাজ্যে বাম জমানার পতনের পর যখন তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার মহাকরণে ঢুকছে, তখন প্রায় অনুচ্চারিত একটি নজির গড়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনিই মু়খ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার একমাত্র সদস্য যাঁর রাজ্যে মন্ত্রীত্ব করার পূর্বঅভিজ্ঞতা ছিল। সেই অর্থে তিনি টিএমসি সরকারের একমাত্র মহাকরণ ঘোরা একজন। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্ব সামলেছেন আগে। কিন্তু রাজ্য সরকারের মন্ত্রীর অভিজ্ঞতা ছিল সুব্রতবাবুর।

বাম জমানার পতনের ঠিক আগে ১৯৭২-১৯৭৭ পর্যন্ত কংগ্রেসের সরকারের সুব্রতবাবু ছিলেন পুলিশ ও তথ্য দফতরের দায়িত্বে। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়।

প্রথম পাঁচ বছরের মন্ত্রিত্বই সুব্রতবাবুর রাজনৈতিক জীবনে সবথেকে আলোচিত। সেই সময়েই অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। তথ্য বিভাগের দায়িত্বে থাকায় বহু ‘অপ্রিয়’ কাজ করতে হয়েছে সুব্রতবাবুকে। জরুরি অবস্থা বিরোধী যে কোনও সংবাদ কেটে দেওয়ার মতো ঘটনা রাজ্যে তাঁর দফতরেই হত। তিনি থাকতেন উপস্থিত। সে কথা পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেছেন। বিশেষ করে ততকালীন বিরোধী দল সিপিআইএমের মু়খপত্র ‘গণশক্তি’ সংবাদ পরিবেশনায় সুব্রতবাবুর নজর থাকত প্রবল।

নিজেই জানিয়েছিলেন “গণশক্তির সরোজ মুখার্জি আমার কাছে এসেছিলেন। ওঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির” ছাপতে চান। আমি সটান না করে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল দেশের যা অবস্থা তাতে ওই কবিতার অন্য অর্থ হবে। এটা আমি ঠিক করিনি৷ এখন ভাবলে খারাপ লাগে” 

জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৭ সালে রাজ্যে কংগ্রেস সরকারের পতন হয়। তৈরি হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। এই দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের বাম জমানাতে বিরোধী কংগ্রেসের তিনমূর্তি ছিলেন প্রিয়-সোমেন-সুব্রত। আর নেই তাঁরা। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে সেই অধ্যায় শেষ হয়ে গেল। তিনি এমন এক রাজনীতিক যিনি বিরোধী হোক বা সরকার সবপক্ষেই নিজ মহিমায় উজ্জ্বল।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় টালমাটাল যুক্তফ্রন্ট সরকার ছিল এ রাজ্যে প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার। ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ এই সময়ে দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকারকে নড়িয়ে দেওয়ার যে ঘটনাবহুল ছক তৈরি হয়েছিল সেই সময়টিতে অর্থাৎ রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাপূর্ণ বামপন্থী রাজনীতির উত্থান সময়ে কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদী ঘরানার দক্ষিণপন্থী তরুন নেতাদের আকাল চলছিল। সেই আকালের বাজারে উদয় প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, সোমেন মিত্র ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। তাবড় তাবড় বাম ও অতিবাম রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে কংগ্রেসি তিন মূর্তির প্রবল আত্মপ্রকাশ সেই যে শুরু হয়েছিল, দীর্ঘ চার দশক পেরিয়ে সুব্রতবাবু ছিলেন সেই জাতীয়তাবাদী ঘরানার সর্বশেষ প্রতিনিধি।

রাজনৈতিক জীবনে প্রথম মাইলফলকটি অবশ্যই ছিল, ১৯৭২ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে রাজ্যে ফের কংগ্রেসের ক্ষমতা দখলে সুব্রতবাবুর মন্ত্রী হওয়া। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সঙ্গে মহাকরণ ও বিধানসভায় ঢুকলেন পুলিশ ও তথ্য দফতরের মন্ত্রী হয়ে। তারপর কংগ্রেস ভেঙে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পরপর দলত্যাগ ফের ফিরে আসা এরকমই চলেছে। একপর্যায়ে মমতাকে নেত্রী বলে মেনেও নিয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন।

সিদ্ধার্থশংকর থেকে শুরু মাঝে জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রীতে বিরোধী পক্ষে আর সর্বশেষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মু়খ্যমন্ত্রীত্বে মন্ত্রিসভাতেই রাজনৈতিক জীবন কাটল। পুরো রাজনৈতিক জীবনে জরুরি অবস্থার মতো সবথেকে বিতর্কিত ঘটনাটি পরে হেসে উড়িয়েছেন। সুব্রতবাবু এমনই। সেটা সবপক্ষই স্বীকার করে নিয়েছেন।