বিশেষ প্রতিবেদন: শম্ভু মিত্র থিয়েটারের পরিকাঠামো নিয়ে কোনও সমঝোতা মানতে রাজি ছিলেন না৷ তাঁর আমলে বহুরূপী-র অভিনয়ের আমন্ত্রণ থাকলে আগে দলের প্রতিনিধি সেখানে গিয়ে দেখে আসতেন মঞ্চ, সাজঘর, আলো ও শব্দ-ব্যবস্থা, এমনকি দর্শক আসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা আছে কিনা৷ তা না হলে দল অভিনয় করত না।
কখনও কখনও নাট্যদলগুলি প্যান্ডেলে অস্থায়ী মঞ্চে বা পরিত্যক্ত প্রেক্ষাগৃহে নাটক নামিয়ে দেন৷ রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রণে এমন কোনও স্থানেও অভিনয় করেন যেখানে নাটকের সংলাপকে আলাদা করা যায় না আশপাশ থেকে ভেসে আসা গান, বক্তৃতা এবং হাঁকডাকের আওয়াজ থেকে৷ এই আপোষ আসলে এক ধরনের প্রতারণার সামিল যেটা কোনও ভাবেই মানতে পারেননি নির্দেশক নট শম্ভু মিত্র৷ মানাতে না পেরে জীবনের শেষদিকে আসতে আসতে একেবারে প্রচারের আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে দেখা গিয়েছিল তাকে ।
১৯১৫ সালের ২২ অগস্ট শম্ভু মিত্রের জন্ম হয় কলকাতায়৷ বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে বিদ্যালয় শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯৩৯ সালে রংমহলে বাণিজ্যিক নাট্যমঞ্চে যোগ দেন তিনি। পরে যোগ দিয়েছিলেন মিনার্ভায়। এই সময় কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে আলাপ হয় এবং তাঁরই প্রযোজনায় আলমগীর নাটকে অভিনয়ও করেন তিনি। যদিও তখন থেকেই নাট্যজগতে শিশিরকুমারের থেকে আলাদা ঘরানা তৈরিতে উদ্যোগী হন শম্ভু মিত্র।
১৯৪২ সালে ফ্যাসিবিরোধী সংঘের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। ১৯৪৩ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি. সি. যোশির অনুপ্রেরণায় যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। ১৯৪৫ সালের ১০ ডিসেম্বর গণনাট্য সংঘে কাজ করার সময়ই তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় মঞ্চাভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের। ১৯৪৮ সালে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠন করেন বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠী। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বহুরূপীর প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সফোক্লিস, হেনরিক ইবসেন, তুলসী লাহিড়ী এবং অন্যান্য বিশিষ্ট নাট্যকারের রচনা তাঁর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়।
ভারতীয় নাটকের ইতিহাসে যেগুলি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৭০ সালে একটি আর্ট কমপ্লেক্স নির্মাণে উদ্দেশ্যে গঠিত হয় বঙ্গীয় নাট্যমঞ্চ সমিতি। তখন আর্ট কমপ্লেক্সের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সমিতির প্রযোজনায় ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মঞ্চস্থ মুদ্রারাক্ষস নাটকে অভিনয়ও করেন তিনি৷ ১৯৭৮ সালের ১৬ জুন অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে দশচক্র নাটকে অভিনয় করেন। বহুরূপীর প্রযোজনায় সেটিই ছিল তাঁর শেষ নাটক। ওই বছরই ১৫ অগস্ট অ্যাকাডেমিতে স্বরচিত চাঁদ বনিকের পালা নাটকটি পাঠ করেন তিনি। এরপর বহুরূপীর আর কোনো প্রযোজনায় তাঁকে দেখা যায়নি।
এদিকে ১৯৭৯ সালে প্রায় দৃষ্টিহীন অবস্থায় নান্দীকার প্রযোজিত মুদ্রারাক্ষস নাটকে চাণক্যের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় বিশেষ সাড়া ফেলেছিল।১৯৮০-৮১ সালে ফ্রিৎজ বেনেভিৎজের পরিচালনায় ক্যালকাটা রিপোর্টারির প্রযোজনায় গ্যালিলিওর জীবন নাটকে অভিনয় করেন। কন্যা শাঁওলী মিত্র পরিচালিত ‘নাথবতী অনাথবৎ’ এবং ‘ কথা অমৃতসমান’ নাটক দু’টির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন শম্ভু মিত্র। কন্যার নাট্যসংস্থা পঞ্চম বৈদিকের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও আমৃত্যু কর্মসমিতি সদস্য ছিলেন। ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রসদনে পঞ্চম বৈদিকের প্রযোজনায় ও তাঁর পরিচালনায় দশচক্র নাটকটির পরপর ছয়টি অভিনয় পাঁচ দিনে মঞ্চস্থ হয়। অভিনেতা রূপে এর পর আর কোনও দিন মঞ্চে অবতীর্ণ হননি তিনি।
১৯৯৭ সালের ১৯ মে কলকাতার বাসভবনে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শম্ভু মিত্র। তবে শুধু মঞ্চ নয় এই অভিমানী নট জনগণের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন৷ তাই মৃত্যুর আগে ইচ্ছাপত্র-এ লিখেছিলেন, “মোট কথা আমি সামান্য মানুষ, জীবনের অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি, তাই মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনই নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তির সঙ্গে গিয়ে পুড়ে যেতে পারে।” এই কারণে সৎকার হওয়ার আগে সংবাদমাধ্যমের কাছে শম্ভু মিত্রের মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছয়নি৷ ফলে অগণিত শম্ভু মিত্রের ভক্ত অনুগামীরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাননি বলে আক্ষেপ করেন ৷