মহালয়া কি শুভ? সবাই ‘শুভ মহালয়া’ বলে কেন?

অনুভব খাসনবীশ: মহালয়ার (mahalaya) দিন থেকেই শুরু হয়ে গেল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের ‘কাউন্টডাউন’! সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়াল উপচে পড়ল ‘শুভ মহালয়ার’ শুভেচ্ছা বার্তায়। মহালয়া কি সত্যিই…

mahalaya

অনুভব খাসনবীশ: মহালয়ার (mahalaya) দিন থেকেই শুরু হয়ে গেল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের ‘কাউন্টডাউন’! সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়াল উপচে পড়ল ‘শুভ মহালয়ার’ শুভেচ্ছা বার্তায়। মহালয়া কি সত্যিই ‘শুভ’ দিন? প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে।

হিন্দু রীতি অনুসারে মহালয়া হল—প্রয়াত তথা শ্রদ্ধেয় প্রিয় পূর্বপুরুষদের জলদান বা তর্পণ করার সর্বশ্রেষ্ঠ তিথি। তাঁদের স্মৃতি স্মরণ করার দিন। তপর্ন মন্ত্রে বলা হয়ে থাকে, “যে বান্ধবা অবান্ধবা বা, যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ। তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত, যে চ অস্মৎ তোয়-কাঙ্খিণঃ।” অর্থাৎ বন্ধু ছিলেন অথবা জন্মজন্মান্তরে বন্ধু ছিলেন তাঁদের জলের প্রত্যাশা তৃপ্তিলাভ করুক। কিন্তু শ্রাদ্ধের দিনকে ‘শুভ’ বলা যায় কি না, প্রশ্ন তা নিয়েই। আবার তর্পণ শব্দটির ব্যুৎপত্তি হয়েছে তৃপ ধাতুর থেকে। তৃপ + অনট, অর্থাৎ তৃপ্তিসাধন। যা অশুভ না ভাবা কাম্য।

দিনটিকে ‘শুভ’ হিসেবে ধরা হবে কি না, তার নির্দিষ্ট কোনও উল্লেখ বা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। পণ্ডিতদের মতে, পঞ্জিকায় কোনও দিনকেই আলাদা করে ‘শুভ’ বলা নেই। এই ঘটনা নিয়ে মহাভারতের একটি জনপ্রিয় আখ্যান রয়েছে। ‘মহাভারত’ অনুসারে, দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে অবস্থান কালে তাঁকে সোনা এবং বিভিন্ন রত্নদ্রব্য খাদ্য হিসাবে দেওয়া হয়। বিস্মিত কর্ণ যমরাজকে (মতান্তরে দেবরাজ ইন্দ্রকে) জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর প্রতি ওই রকম ব্যবহারের কারণ কী?

যমরাজ বললেন, — ‘হে কর্ণ, তুমি জীবনভোর শুধু শক্তির আরাধনা করে গেছ। কখনও নিজের পূর্বপুরুষের কথা ভাবনি, তাঁদের প্রয়াত আত্মাকে খাদ্য-পানীয় দাওনি। তাই পুণ্যফলে তুমি স্বর্গে আসতে পারলেও খাদ্য-পানীয় পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হওনি। সেই জন্যেই তোমার প্রতি এই ব্যবহার।

কর্ণ বললেন— “হে ধর্মরাজ! এতে আমার দোষ কোথায়? জন্ম মুহূর্তেই আমার মা আমাকে ত্যাগ করেন। সূত বংশজাত অধিরথ ও তাঁর স্ত্রী আমাকে প্রতিপালন করেন। তার পর আমার শৌর্য দেখে দুযোর্ধন আমাকে আশ্রয় দেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আরম্ভের আগের দিন প্রথমে কৃষ্ণ ও তার পরে মাতা কুন্তী এসে আমার জন্ম ও বংশ পরিচয় জানিয়ে দেন।” কর্ণ স্বীকার করেন, তিনি পিতৃপুরুষ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। সেই কারণে তিনি পিতৃপুরুষকে অন্ন এবং জল দান থেকে বিরত ছিলেন।

কর্ণকে এক পক্ষকাল সময় দেওয়া হয় মর্ত্যলোকে গিয়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জল দান করে পিতৃপুরুষের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য। এই সময়কাল ছিল পিতৃপক্ষ, ১৬ দিন। যমের (বা ইন্দ্রের) নির্দেশে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপ্রতিপদ তিথিতে কর্ণ আবার মর্ত্যে ফিরে এসে এক পক্ষ কাল থেকে পিতৃপুরুষকে তিল-জল দান করে পাপস্খলন করলেন। এই বিশেষ পক্ষকাল সময়কে শাস্ত্রে পিতৃপক্ষ বলা হয়েছে। পিতৃপক্ষের শেষ দিন হল মহালয়া।

হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে দান করা জলে তাঁদের তৃষ্ণা নিবারণ হয়। যাঁরা পূর্বপুরুষের বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে সক্ষম হন না। তাঁরা পিতৃপক্ষে পূর্বপুরুষকে জল দান করতে পারেন। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে মহালয়ার পর প্রতিপদে যে বোধন হয় সে সময়ও সংকল্প করে দুর্গা পূজা করা যায়। একে বলে প্রতিপদ কল্পরম্ভা। সর্বশেষে একটিই কথা বলা যায়, মহালয়া শুভ না অশুভ তা নিয়ে তর্ক চললেও, ‘হ্যাপি’ কখনোই নয়।