আবদুলের আকাশ: তালিবানি ফতোয়া কেটে পলাতক আফগান মহাকাশচারী

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: তখন আফগানিস্তানের শাসনে সে দেশের কমিউনিস্ট দল পিডিপি। দলটির ‘খালাক’ গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা। প্রতিবেশী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ মদতে আফগানিস্তান ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। ইসলামি…

Abdul Ahad Momand first Afghan citizen to journey to outer space

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: তখন আফগানিস্তানের শাসনে সে দেশের কমিউনিস্ট দল পিডিপি। দলটির ‘খালাক’ গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা। প্রতিবেশী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ মদতে আফগানিস্তান ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। ইসলামি শাসনতন্ত্র কায়েম করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে (মুজাহিদিন) সরাসরি সংঘর্ষে নেমেছিল।

আফগান সরকারে থাকা পিডিপি দলের মধ্যে চলছিল টানাপোড়েন। এই টানাপোড়েনের মাঝেই কমিউনিস্ট খালাক গোষ্ঠীকে সরিয়ে কুর্সি দখল করে অপর গোষ্ঠী পরচম। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৮০ দশকে আফগানিস্তান জুড়ে শুরু হয়েছিল মহাকাশ বিজ্ঞানের চর্চা !!

মহাকাশ বিজ্ঞান-স্পেস সায়েন্স এসব নাম আফগানিস্তানের সঙ্গে যায়-ই না !! কারণ এই দেশ তো আমাদের চোখে সুদখোর, কিসমিস বেচা কাবুলিওয়ালাদের দেশ। তবে তলিয়ে দেখলে জানা যায়, আফগানিস্তান ভারতের আগে স্বাধীনতা পাওয়া দেশ। সেই দেশ বরাবর ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র পথকে সমর্থন জানিয়েছে।

Abdul Ahad Momand

পড়ুনঃ লেনিনের সমর্থনে আফগানিস্তানেই হয় ভারতের প্রথম ‘বিপ্লবী সরকার’

এমনই আফগানিস্তান তখন সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত। আফগান জনজীবনে লেগেছে ইউরোপিয়ান স্পর্শ। কাবুল, জালালাবাদ সহ দেশটির সর্বত্র রাস্তায় রাস্তায় বোরখা প্রায় ভুলে গেছেন মহিলারা। এসেছে ইউরোপীয় পোশাক। এমনই সময়ে আফগান সরকার উদ্যোগ নেয় মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চার। মস্কো রাজি হয়। শুরু হলো আকাশের ঠিকানায় আফগানি কিসমিসের কাহিনি লেখার পালা।

আফগানিস্তান তখন পরিচিত গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ও পরে আমীরতন্ত্র থেকে বহুদূরে আফগানিস্তান ছিল। ‘৮০ দশক। প্রতিবেশি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ মদতে আফগানিস্তানে চলছিল কমিউনিস্ট সরকার। আমেরিকার মদতে ধর্মীয় মুজাহিদিন বিভিন্ন গোষ্ঠী তখন সোভিয়েত বিরোধী লড়াই করছে। তাদের পক্ষ নিয়ে কলকাতা, শিলিগুড়ি সহ বিভিন্ন জেলায় বুদ্ধিজীবীরা বলছিলেন, “সোভিয়েত সরকার আফগানিস্তানকে গোল্লায় পাঠাচ্ছে”। ঠিক তখনই আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকার সোভিয়েত সাহায্যে তাদের দেশের প্রথম মহাকাশ অভিযান চালায়।

Abdul Ahad Momand

বিশ্ববিখ্যাত সোভিয়েত মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘মির’ (নাসার চক্ষুশূল) থেকে ব্রহ্মাণ্ড পরিভ্রমণ করেছিলেন আফগান মহাকাশচারী আবদুল আহদ মোহামন্দ। ১৯৮৮ সালের ২৯ আগস্ট দিনটা আফগানিস্তান তো বটেই, বিশ্বের মহাকাশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশ শুধু এক গোলি এক দুশমন রীতিতে বিশ্বাসী, তাদের প্রতিনিধি হয়েছে আবদুল আহদ মহাকাশে বিচরণ করছিলেন। আফগানিস্তান শুরু করেছিল মহাকাশ বিজ্ঞানের কাহিনি লিখতে।

তখন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ডক্টর মহম্মদ নাজিবুল্লাহ। তিনি সোভিয়েত অনুরাগী। তাঁর অনুরোধেই আফগান বিমান সৈনিক আবদুল আহদকে সোভিয়েত বলশেভিক সরকার সুযোগ দিয়েছিল মহাকাশ পরিভ্রমণের। মহাকাশ থেকে বিশেষ টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট ডক্টর নাজিবুল্লাহের সঙ্গে কথা বলেন আফগান মহাকাশযাত্রী, বৈজ্ঞানিক, বিমান সৈনিক আবদুল আহদ। গোটা আফগান জাতি তো বটেই বিশ্ব সেলাম করেছিল।

সোভিয়েত মহাকাশ বিজ্ঞান কেন্দ্র ইউরি গ্যাগারিন রিসার্চ সেন্টারে দীর্ঘ সময় তালিম নেন আফগান মহাকাশচারী আবদুল আহদ। তাঁকে মহাকাশে পাঠানোর বিষয়ে সোভিয়েত সরকার নিয়েছিল যাবতীয় উদ্যোগ। সুযোগ্য ছাত্র হিসেবে আবদুল সবকিছু শিখে দুই রুশ মহাকাশচারীর সঙ্গে পৃথিবী ছেড়েছিলেন। তারপর মহাকাশে তাঁদের পরিভ্রমণ পালা।

১৯৮৮ সালের পর আফগানিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। প্রতিবেশি সোভিয়েতে অভ্যন্তরে শুরু হয় রাজনৈতিক বিতর্ক। সেই ধাক্কা লাগতে শুরু করে আফগানিস্তানে। নব্বই দশকে টুকরো হয়ে যায় সোভিয়েত। স্বাভাবিকভাবেই আফগানিস্তানে এর প্রভাব পড়েছিল।

সোভিয়েতকে ভাঙার অভিযুক্ত তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিখাইল গরবাচেভ। কাবুল জুড়ে রাজনৈতিক গালিচার রঙ পাল্টে যাচ্ছিল। গরবাচেভ সফল হলেন। সোভিয়েত ভাঙল। সোভিয়েত পতন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম অধ্যায়।
নব্বই দশকে কমিউনিস্ট বলশেভিক সরকারের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙতেই কাবুলের কমিউনিস্ট সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়। প্রেসিডেন্ট ডক্টর নাজিবুল্লাহর সরকারের পতন হল। এরপর কখনো গুলাবুদ্দিন হেকমতিয়ার, তো কখনো বুরহাউদ্দিন রব্বানির মিলিশিয়া হামলা। অরক্ষিত কাবুলের রাষ্ট্রসংঘ কার্যালয়ে থাকা নাজিবুল্লাহ বুঝছিলেন বাঁচা অসম্ভব। এসবই গত শতাব্দীর ‘৯০ দশকের ঘটনা।

নাজিবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সোভিয়েত অনুরাগী মার্শাল আবদুল রশিদ দোস্তাম আর সোভিয়েত বিরোধী ‘পঞ্জশিরের সিংহ’ আহমেদ শাহ মাসুদের বন্ধুত্ব তৈরি করল ধোঁয়াশা। পথ আলাদা তবে দুজনেরই শত্রু তালিবান। এই জোট চেয়েছিল নাজিবুল্লাহকে রক্ষা করতে। নাজিবুল্লাহ বুঝতে পারেননি। হয়তবা দোস্তাম-মাসুদের সহাবস্থান মানতে পারেননি। একলা হয়ে গেলেন।

রাতের পর রাত, কাবুলের রাজপথ ধরে সোভিয়েত লাল তারা মার্কা ট্যাংকগুলো ঘড়ঘড় করে চলছিল পশ্চিম দিকে -উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তানের দিকে। সোভিয়েত সেনা সরতে সময় নিয়েছিল। বিরাট সামরিক বহর যেদিন পুরোপুরি আফগানিস্তান ত্যাগ করল তখনই কাবুলে ঢুকল তালিবান। কাবুল দখল করে রাষ্ট্রসংঘ কার্যালয় ঘিরে নিল তালিবান জঙ্গিরা।

নাজিবুল্লাহ একটি কাজ করতে পেরেছিলেন। স্ত্রী সন্তানদের নয়াদিল্লি পাঠাতে পেরেছিলেন। মার্কিন চাপে রাষ্ট্রসংঘের কাবুল কার্যালয়ের দরজা খুলে দিল স্টেনগানধারী রক্ষীরা। তাদের সামনে দিয়েই তালিবান জঙ্গিরা টেনে আনল মহম্মদ নাজিবুল্লাহকে। মেরে ঝুলিয়ে দিল লাইট পোস্টে। ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কাবুলে তৈরি হল প্রথম তালিবান সরকার।

নাজিবুল্লাহকে খুনের কয়েকদিন আগেই আফগানিস্তান ছাড়েন মহাকাশচারী আবদুল আহদ। কাবুল থেকে মস্কো যান। সেখানে আর ঠাঁই হয়নি সোভিয়েত জমানার বিশ্বশ্রেষ্ঠ মির মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের একমাত্র আফগানি মহাকাশ বিজ্ঞানীর। ‘লাল তারা’ পদক লুকিয়ে মস্কো থেকে জার্মানিতে চলে যান আবদুল আহদ।

গত তিরিশ বছর সেখানেই রয়েছেন আবদুল আহদ। মহাকাশের সঙ্গে তেমন যোগ নেই। ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশ চর্চা কেন্দ্রের আফগানি গবেষক এখন প্রৌঢ় জার্মান নাগরিক। টিভিতে কাবুলের পতন দেখলেন আবার। হয়ত একটু দীর্ঘশ্বাস পড়েছে।