নিউজ ডেস্ক: যেখানেই মুক্তি সংগ্রাম সেখানেই হাজির লন্ডন টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা সাইমন ড্রিং। ষাট-সত্তর দশকে কখনো ভিয়েতনাম তো কখনও ঢাকা, পরে হাইতির গণসংগ্রামের রিপোর্টার প্রয়াত হলেন। কিংবদন্তি সাংবাদিকের বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তাঁর পাঠানো বিশ্ববিখ্যাত সংবাদগুলির অন্যতম “ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান “। এই শিরোনামে লন্ডন টেলিগ্রাফ খবর প্রকাশ করতে বিশ্ব কেঁপে গিয়েছিল। স্পষ্ট হয়েছিল ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঠিক কী ঘটাচ্ছে পাকিস্তানের সেনা। জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে শুরু হয়েছিল গণহত্যা ও শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নেমেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রের হয়ে ভিয়েতনামে আমেরিকান সেনার বর্বরতা লিখে বিশ্ব কাঁপাচ্ছিলেন সাইমন ড্রিং। সেখান থেকে তাঁকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির খবর সংগ্রহ করতে পাঠান লন্ডন টেলিগ্রাফ কর্তৃপক্ষ। ১৯৭১ সালের ঢাকা তখন পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র গণ আন্দোলনের কেন্দ্র।
সাইমন ড্রিং ভিয়েতনাম থেকে ঢাকা আসার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিঘোরালো হয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সরকার ঢাকায় গণহত্যা “অপারেশন সার্চলাইট” শুরু করে। বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা থেকে জোর করে করাচি নিয়ে যায় পাক সেনা। কিন্তু টিক্কা খানের সেনাবাহিনি কে টেক্কা দিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। তিনি আত্মগোপন করেন ঢাকার বিখ্যাত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভিতর। ২৫ মার্চের ভয়াবহ ট্যাংক অভিযান ও গণহত্যার বিবরণ তিনিই হোটেল থেকে দেখে সাংকেতিক আকারে লিখে রাখেন। তাঁর খোঁজে হোটেলে পাক সেনার তল্লাশি চলছিল। সাইমন ড্রিং গুটিকয়েক হোটেল কর্মীর সাহায্যে কখনো জলের ট্যাংকের ভিতরে, চেয়ার টেবিলের আড়ালে, রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলেন।
২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নেয় পাক সরকার। মৃতদেহে ঢেকে থাকা ঢাকার রাজপথে প্রবল ঝুঁকি নিয়ে ছবি ও বিবরণ সংগ্রহ করেন সাইমন ড্রিং। তারপর লেখেন ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদন ৩০ মার্চ প্রকাশ করে লন্ডন টেলিগ্রাফ। আন্তর্জাতিক এক্সক্লুসিভ এই বিবরণ পাকিস্তানের মুখোশ খুলে দেয়। সংবাদ প্রকাশের পরেই আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র শেরগোল পড়ে যায়।
আর লুকিয়ে থাকা সম্ভব হয়নি। সাইমন ড্রিংকে বন্দি করে পাক সরকার। প্রবল অত্যাচার করে তাঁকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় তাকে অবশ্য ছাড়তে বাধ্য হয় পাকিস্তান। লন্ডন ফিরে সাইমন ড্রিং ঢাকার বিবরণ পরপর প্রকাশ করতে থাকেন। গণহত্যার সেই বিবরণগুলি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন ফেলে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য সাইমন ড্রিং লন্ডন থেকে কলকাতা আসেন। কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকা থেকে ঘুরে এসে প্রতিবেদন লিখতেন। টানা ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের থেকে ছিন্ন হয়ে তৈরি হয় বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাইমন ড্রিং নতুন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আসেন ভারতীয় সেনার সঙ্গে। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন সাইমন ড্রিং।
শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নয়, হাইতি দ্বীপের গণসংগ্রামে আমেরিকান সেনার হামলার খবর ঘটনাস্থল থেকে লিখেছেন তিনি। প্রবল বিভিন্ন পড়েছিল ওয়াশিংটন। আর ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের রিপোর্ট লিখে সাইমন ড্রিং তো মার্কিন সরকারের চক্ষুশূল হয়েইছিলেন। অকুতোভয় সাংবাদিক পরে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ কথক সাইমন ড্রিংয়ের প্রয়াণ সংবাদে বাংলাদেশ, হাইতি, ভিয়েতনাম শোকস্তব্ধ।