বাংলার প্রথম অভিধান লিখতে সময় লেগেছিল ৪০ বছর

অনুভব খাসনবীশ: অভিধান বা শব্দকোষ, যেকোনো ভাষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। কারণ, ভাষার আঁধার হল শব্দ। সেই শব্দ এবং তার বিবিধ ব্যবহারই ধরা থাকে অভিধানে।…

Haricharan-Banerjee

অনুভব খাসনবীশ: অভিধান বা শব্দকোষ, যেকোনো ভাষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। কারণ, ভাষার আঁধার হল শব্দ। সেই শব্দ এবং তার বিবিধ ব্যবহারই ধরা থাকে অভিধানে। অভিধানবিহীন ভাষার কথ্যরুপে অস্তিত্ব থাকলেও লেখ্যরুপে সেই ভাষার গুরুত্ব থাকে না। ইমারতের ভীতের মতোই যা তৈরী করতে অত্যন্ত আদরে, যত্নে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সেই কাজটিই করেছিলেন ভাষা-সাধক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রায় চল্লিশ বছরের সাধনার ফল ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।

আরও পড়ুন পচাত্তর পেরিয়ে আজও বাঙালির প্রিয় শালিমার

২৩ জুন, ১৮৬৮ সালে রামনারায়ণপুর, চব্বিশ পরগণায় জন্ম হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পিতা নিবারণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। মায়ের নাম জগৎমোহিনী দেবী। শৈশবের অনেকটা সময় হরিচরণ মামাবাড়িতে কাটিয়েছেন। তারপর চলে আসেন নিজের পৈত্রিক ভিটেয়, যশাইকাটি গ্রামে। (উইকিপিডিয়া মতে, গ্রামটির নাম মশাইকাটি। আবার, বাংলাপিডিয়ায় তার পৈতৃক গ্রামের নাম লেখা জামাইকাটি।)

আরও পড়ুন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন কলেজের ইতিহাস

সেখানে প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর কলকাতায় এসে ভর্তি হন জেনারেল এসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশনে। বর্তমানে যার নাম স্কটিশ চার্চ কলেজ। তারপর ভর্তি হন মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনে বা বর্তমানের বিদ্যাসাগর কলেজে। স্কটিশ চার্চে পড়ার সময়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তাদের পরিচয়ের শুরু নাটক থেকে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে প্রায়ই নাটক হতো। সেখানে অভিনয় করতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কিশোর হরিচরণ সে নাটকের খবর পেয়ে ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ নাটক দেখতে আসেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। সেখানেই আলাপ কবিগুরুর সঙ্গে।

এই কবিগুরুর সুপারিশেই তিনি ভর্তি হন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে। মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনের বেতন তখন তিন টাকা। এই বেতন দেওয়া তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না কিশোড় হরিচরণের পক্ষে। খোঁজ-খবর নিয়ে জানলেন, পটলডাঙার মল্লিক পরিবার এই কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বেতন দেন। সেই বৃত্তির জন্য দরখাস্ত করলেন কলেজের সভাপতির কাছে। ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন তখন সেখানকার সভাপতি। দরখাস্তের সঙ্গে দুটি সুপারিশপত্র জুড়ে দিলেন হরিচরণ। একটি চিকিৎসক চন্দ্রমোহন ঘোষের, আরেকটি রবীন্দ্রনাথের!

আরও পড়ুন কালের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস

কিন্তু ভাগ্যের ফেরে পড়া শেষ করতে পারেননি তিনি। বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারের দায়িত্ব নিতে চাকরীতে ঢুকতে হয় তাকে। কলকাতা টাউন স্কুলের প্রধান পণ্ডিত নিযুক্ত হন তিনি। বছরখানেকের মধ্যে শিক্ষকতা ছেড়ে সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে কাজ নিলেন পতিসরের কাচারিতে। পতিসর তখন ঠাকুরবাড়ির জমিদারির অন্তর্গত। ততদিনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দেখাশোনা শুরু করেছেন। অর্থাৎ হরিচরণ হয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথদের কর্মচারী।

কাচারি পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ সেবছরেই পতিসরে এলেন। হরিচরণের সঙ্গে কথায় কথায় জানতে পারলেন যে শুধু জমিদারি দেখাশোনার কাজই নয়, সংস্কৃতের আলোচনা এবং প্রেসের কপি-পাণ্ডুলিপিও প্রস্তুত করেন তিনি। হরিচরণের লেখা সেই পান্ডুলিপি দেখলেন তিনি। কিছুদিন পর পতিসরের ম্যানেজার শৈলেশচন্দ্র মজুমদারকে জানালেন, সংস্কৃতজ্ঞ সুপারিন্টেন্ডকে যেন তাঁর কাছে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯০২ সালে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে সংস্কৃতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন ‘সুলেখা কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’, বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি

সেখানে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাকে রবীন্দ্রনাথ দায়িত্ব দিলেন ‘সংস্কৃত প্রবেশ’ রচনা করার। সেটি শেষ হওয়ার আগেই পেলেন নতুন দায়িত্ব, কবিগুরু তাকে জানালেন, “বাংলা ভাষার কোনো শব্দকোষ নেই, তোমাকে একটি অভিধান লিখতে হবে।” যদিও তখনও সেই হয়নি সংস্কৃত প্রবেশ রচনার কাজ। হরিচরণ সময় চেয়ে নিলেন গুরুর কাছ থেকে। ১৯০৫ সালে তিন খন্ডের সংস্কৃত প্রবেশ রচনা শেষ হয়। তারমধ্যেই রচনা ফেলেছেন একটি ‘পালি প্রবেশ’ও। পালি ভাষা না হলেও, বাংলা ভাষার তৎসম ও তদ্ভব শব্দের সঙ্গে সংস্কৃতের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ফলে সংস্কৃত প্রবেশ এবং পালি প্রবেশ লেখার অভিজ্ঞতা তাকে সাহায্য করেছিল বাংলা অভিধান লেখার ক্ষেত্রে।

বঙ্গীয় শব্দকোষ' হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুড়ি বছরের সাধনার ফসল,এই কাজের  জন্যে হারিয়েছিলেন দৃষ্টিশক্তি | Bangla Amar Pran - The glorious hub for  the Bengal ...

যদিও তাঁর কাছে কোনো অভিজ্ঞ আভিধানিকও ছিল না ধারণা পাওয়ার জন্য। সে কথাই তিনি লিখে গেছেন বঙ্গীয় শব্দকোষের ‘সংকলয়িতার নিবেদন’ অংশে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “অভিধান সংকলনে কেহই আমার পথপ্রদর্শক ছিলেন না; কোন বিজ্ঞ অভিধানিকের সাহায্যলাভের আশাও করিতে পারি নাই। নিজ বুদ্ধিতে যে পথ সহজ বুঝিয়াছিলাম, তাহাই আশ্রয় করিয়া কায্যে অগ্রসর হইয়াছি; অসহায়ভাবে কায্য করার ফলে, ব্যর্থ পরিশ্রমে আমার অনেক সময় নষ্ট হইয়াছে। তখন অভিধান-রচনার অনুরূপ উপকরণসঞ্চয়ের নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম এবং অধ্যাপনার অবসানে নানা বাঙলা পুস্তক পাঠ করিয়া প্রয়োজনীয় বিষয় সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। আশ্রমের গ্রন্থাগারে যে সকল প্রাচীন বাঙলা গ্রন্থ ছিল, প্রথমে তাহা হইতেই অনেক শব্দ সংগৃহীত হইল। এই সময়ে প্রাচীন ও আধুনিক প্রায় পঞ্চাশখানি গদ্য-পদ্য গ্রন্থ দেখিয়াছিলাম। তদ্ভিন্ন সেই সময়ে প্রকাশিত বাঙলাভাষার অভিধান, ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’সমুহে প্রকাশিত প্রাদেশিক শব্দমালা ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কৃত ‘শব্দসংগ্রহ’ হইতে অনেক শব্দ সঞ্চিত হইয়াছিল। প্রাকৃতব্যাকরণ হইতেও অনেক বাঙলা শব্দের মূল সংস্কৃত শব্দ ও তদ্ভব শব্দও কিছু লিপিবদ্ধ করিয়াছিলাম। ইহাতে আমার প্রায় দুই বৎসর অতীত হয়। ১৩১৪ সালের ১৬ চৈত্র আমার শব্দ-সংগ্রহের সমাপ্তির দিন।”

১৩১৭ বঙ্গাব্দে গিয়ে সেই সংগ্রহ করা শব্দ সাজানো শেষ হলো। এরপর শুরু হল বাংলার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংস্কৃত শব্দের সংযোজন। সেগুলোর বুৎপত্তি, সত্যিকারের প্রয়োগ ও ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ইত্যাদিও লিপিবদ্ধ করলেন তিনি। হরিচরণের ভাষায়—ইহাই প্রকৃত শব্দ-সংগ্রহের শুরু। ঠিক সে সময়েই শান্তিনিকেতনে শুরু হল টাকা-পয়সার টানাটানি। বাধ্য হয়ে সেখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে হরিচরণ কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজে সংস্কৃত পড়ানোর কাজ নিলেন। তাতে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেল শব্দকোষ লেখার কাজ, হরিচরণের মনও পড়ে রইল শান্তিনিকেতনে।

সেকথা জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখলেন মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীকে। কবিগুরুর অনুরোধে সেসময়ে দানশীল বলে পরিচিত মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী হরিচরণকে প্রতিমাসে ৫০ টাকা বৃত্তি দেবেন বলে ঠিক করেন। সেই কথামতোই ১৩১৮ থেকে ১৩২৬ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত নয় বছর ৫০ টাকা করে, এবং পরের চার বছর ৬০ টাকা করে বৃত্তি দিয়ে গেছেন হরিচরণকে। ১৩৩০ বঙ্গাব্দ, ইংরেজী ১৯২৩ সালে এসে অভিধান রচনার প্রাথমিক কাজ শেষ হয়। রচিত হয় বঙ্গীয় শব্দকোষ।

এই দেড় দশকে নিজেকে একেবারে নিংড়ে দিয়েছিলেন হরিচরণ। তা বোঝা যায় আনন্দবাজার পত্রিকার সেই সময়ের প্রকাশিত লেখা দেখলে। সুরঞ্জন ঘোষ একটি লেখায় বর্ণনা দিয়েছেন—‘‘প্রতিদিন সান্ধ্য আহ্নিক সেরে লন্ঠনের আলোয় কুয়োর ধারে খড়ের চালাঘরে পশ্চিম জানলার কাছে হরিবাবু কাজ করতেন। ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও যখনই হরিচরণের বাড়ি যেতেন, দেখতেন তক্তপোষের উপর ডাঁই করে রাখা উর্দু, পার্সি, ইংরেজি, ওড়িয়া, মারাঠি-সহ বিভিন্ন ভাষার অভিধান ছড়ানো রয়েছে।

প্রাথমিক ভাবে অভিধান লেখার কাজ শেষ হওয়ার পর এবার সামনে এসে দাঁড়াল আরেক সমস্যা। সেই অভিধান ছাপাতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো লাগবে। কিন্তু ছাপানোর জন্য পয়সা কে দেবে? মনে রাখতে হবে এর আগে বাঙলা ভাষার কোনও অভিধান ছিল না। ফলে এর গুরুত্ব বোঝার মতো লোক সে সময়ে খুব কম ছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল, এই শব্দকোষ বিশ্বভারতী থেকে ছাপা হবে। বিধুশেখর শাস্ত্রী ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দিলেন রবীন্দ্রনাথ।

আরও পড়ুন বাস্তবের সিধুজ্যাঠাই ছিলেন কলকাতার শেষ বাবু

পরবর্তী দশ বছর টাকার খোঁজে লেগে থাকলেন প্রত্যেকে। ফলে ওভাবেই পড়ে রইল পাণ্ডুলিপি। হরিচরণ এই সময়ের মধ্যে তিনি সবটা পাণ্ডুলিপিকে আরো ঘষামাজা করলেন। দশ বছর পর ‘বিশ্বকোষ’ নামে একটি প্রকাশনীর মালিক নগেন্দ্রনাথ বসু রাজি হলেন অভিধানটি প্রকাশ করতে।

No photo description available.

শেষ পর্যন্ত পুরো অভিধানটি প্রকাশিত হয় ১০৫ খণ্ডে। বিশ্বভারতী কোনো ধরনের কমিশন ছাড়াই বিক্রির দায়িত্ব নিল। পরে ১৯৬৬-৬৭ সালে পুরো বঙ্গীয় অভিধানটি সাহিত্য অ্যাকাডেমি দুখণ্ডে প্রকাশ করে। যদিও তার আগেই ১৯৫৯ সালের ১৩ জানুয়ারি এই ভাষা-সাধকের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক পান তিনি। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন আচার্য জওহরলাল নেহরুর হাত থেকে পান বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দেশিকোত্তম।