Special Correspondent, Kolkata: মেয়ে হয়ে জন্মালেও কৈশোর ছোঁয়ার ঠিক মুখে, ১২ বছর বয়সে তারা পুরুষ হয়ে যায়! এমন লিঙ্গ রূপান্তরের কথা কখনও শুনেছেন কি? শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, লাতিন আমেরিকার ডমিনিক্যান রিপাব্লিকের সালিনাস নামের গ্রামে এমনটাই হয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। সে গ্রামের শিশুকন্যারা সকলেই বড় হয়ে ১২-১৩ বছরে পৌঁছলেই পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কোনও রূপক বা প্রতীকী অর্থে নয়, একেবারে শারীরিক ভাবে অর্থাত্ বায়োলজিক্যালি তারা পাল্টে যায় পুরুষে।
কী ভাবে ঘটে এমনটা? অবাস্তব মনে হলেও ঘটনা সত্যিই ঘটে ডমিনিকের দক্ষিণ-পশ্চিমে বারাভোনা প্রভিন্সের প্রত্যন্ত গ্রাম সালিনাসে। দীর্ঘ দিন ধরে চলা গবেষণার পরে জানা গিয়েছে, এটা আসলে এক ধরনের শারীরিক ত্রুটির ফলাফল। বাচ্চারা যখন মায়ের গর্ভে থাকে, তখনই এই ত্রুটির প্রভাব পড়তে শুরু করে তাদের শরীরে। গর্ভাবস্থায় একটি বিশেষ এনজাইমের অভাবেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়।
গবেষক ও চিকিৎসকেরা বলছেন, সাধারণত গর্ভাবস্থার অষ্টম সপ্তাহ নাগাদ শিশুর শরীরের যৌনাঙ্গ পরিস্ফুট হতে শুরু করে। ডিহাইড্রো টেস্টোস্টেরন নামের একটি হরমোনের প্রভাবে গর্ভস্থ শিশুদের পুং জননাঙ্গ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এই হরমোনকে আবার সক্রিয় করে তোলে একটি বিশেষ ধরনের এনজাইম। কিন্তু সালিনাস গ্রামের মায়েদের গর্ভকালীন পুষ্টির অভাবের কারণেই এই এনজাইম তাঁদের পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্ষরণ হতে পারে না। ফলে যারা আদতে পুরুষ শিশু, জন্মের সময়ে তাদের পুরুষাঙ্গ ঠিকমতো গঠিতই হয়।
সেই শিশুর জন্মকালে তার যৌনাঙ্গ এতই অস্পষ্ট থাকে, যে বাবা-মায়েরা বুঝতেই পারেন না তাঁদের বাচ্চাটি আসলে ছেলে। মেয়ের মতো করেই বাবা-মা মানুষ করতে থাকেন তাকে। কিন্তু ১২ বছর বয়সে যখন পুরুষ শরীরে দ্বিতীয় বারের জন্য টেস্টোস্টেরনের জোয়ার আসে প্রকৃতির নিয়ম মেনেই, তখন তাদের শরীরে ফুটে উঠতে থাকে পুরুষালি লক্ষণ। এবং তখন বোঝা যায়, বাচ্চাটি আসলে পুরুষ।
জানুন সেই গ্রামের বাসিন্দা জনির কথা
সালিনাস গ্রামের বাসিন্দা, ২৫ বছর বয়সি এক পুরুষ জনি, এই রকমই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন শৈশবে। অবশ্য তখন তিনি সমস্যা হিসেবে বোঝেননি এমনটা। জনি বলেন, “আমি ছোটবেলায় স্কুলে যেতাম স্কার্ট পরে। মাথায় থাকত বিনুনি। কোনও দিনই অবশ্য একটা মেয়ের মতো মনে হয়নি নিজেকে। কিন্তু ১২ বছর বয়স থেকে আমার পুরুষাঙ্গ আকারে বাড়তে থাকে। আমি নিশ্চিত হয়ে যাই যে, আমি এক জন পুরুষ।” এখন সমাজের চোখেও জনি এক জন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ।
জনির মতো মানুষ আরও অনেকেই রয়েছেন সালিনাসে। জনির মত আরও অনেক ছোট ছোট ছেলেদের ঠিক একই অবস্থা। ১২ বছরের আগে তারা সবাই মেয়ে থাকে। আবার ১২-তে পা দিলেই তাদের পুরুষাঙ্গ গঠিত হয়ে তারা ছেলেতে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালে এই গ্রামের এই অদ্ভুত পরিস্থিতির বিষয়টি প্রথম আবিষ্কার করেন ডঃ মাইকেল মোসলে নামের এক চিকিৎসক। তার পরেই সারা দুনিয়ার সামনে আসে এই বিচিত্র বিকৃতির কথা।
কিন্তু এই বিকৃতির পিছনে রয়েছে নির্মম সত্য। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে যতই মজাদার বা অদ্ভুত লাগুক, আসলে কিন্তু বিষয়টির নেপথ্যে রয়েছে খুবই খারাপ এবং নিষ্ঠুর বাস্তব। মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটা দূরের সালিনাস গ্রামের গভীর অসুখ দারিদ্র্য। এই কারণেই পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে ভুগতে হয় সকলকে। গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে এই অভাব আরও প্রকট। আর তারই প্রভাব পড়ে গর্ভস্থ শিশুদের শরীরেও। জেনেটিক ডিসঅর্ডারে ভোগে তারা। স্থানীয় বাসিন্দারা এই অসুখের নাম দিয়েছেন ‘১২ বছরে পুরুষাঙ্গ রোগ’ বা ‘গুয়ভেন্ডোকেস’ (Guevedoces)।
জনিকে যেমন সবাই ১২ বছরের আগে বলত মেয়ে। পুরুষাঙ্গ গঠিত হওয়ার পরে জনিকে এখন সবাই ছেলে বলে মানতে শুরু করেছে। এই গ্রামের এটাই নিয়ম। ১২ বছর না হলে বোঝা মুশকিল, সে মেয়ে না ছেলে। স্থানীয়রা জানালেন, এই গ্রামের ছ’জনকে সবাই মেয়ে বলেই চিনত। তারা ফ্রক বা মহিলাদের অন্য কোনও পোশাক পরেই গ্রামে ঘুরত। চলতি বছর ১২-তে পা দিতেই তাদের পুরুষাঙ্গ গঠিত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এখন সকলেই পুরুষ।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
নিউইয়র্কের জিনগত রোগের গবেষক গ্যারি ফ্রু জানান, বংশগতির একটি দুর্লভ জিনের কারণে মানুষ ‘গুয়ভেন্ডোকেস’ নামের এই জিনগত অসুখে আক্রান্ত হয়। এই অসুখে আক্রান্তরা পুরুষের অন্তর্গত সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। কিন্তু জননাঙ্গের আকৃতিগত কারণে তা প্রকাশ পায় না। তাই শিশুটি ছেলে নাকি মেয়ে তা জানতে অপেক্ষা করতে হয় বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত।
<
p style=”text-align: justify;”>এই এলাকার মানুষের মধ্যেই এই জিনের মিউটেশন ঘটার কারণে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এমনটাই হয়ে আসছে সালিনাসে। তবে এখন সালিনাস গ্রামের মানুষেরা সালিনাসের বাইরের মানুষকে বিয়ে করছেন প্রায়ই। ফলে মিশ্র রক্ত নিয়ে তৈরি হওয়া সন্তানেরা স্বাভাবিক যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্মাতে শুরু করেছে। গবেষকদের আশা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা গ্রামটিই এক দিন ত্রুটিমুক্ত হবে।