অনুভব খাসনবীশ: ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের কুখ্যাত বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিনত হয় পূর্ণাঙ্গ স্বদেশী আন্দোলনে। এই স্বদেশী আন্দোলন এশিয়ান পেইন্টস, টাটা স্টিল, ল্যাকমের মতো আরও অনেক আইকনিক ব্র্যান্ডের জন্ম দেয়। এই ব্র্যান্ডগুলি কেবল বিদেশী পণ্য বিক্রয়কেই কমিয়ে করে দেয়নি, ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছিল বাঙালিদেরও। ঠিক সে সময়েই মহাত্মা গান্ধী চিঠি ও আবেদনপত্র লেখার জন্য দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি কালি খুঁজছিলেন। তিনি তাঁর এই চাহিদার কথা জানান স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশ চন্দ্র দাস গুপ্তকে।
সে সময়েই সতীশ চন্দ্র দাস গুপ্তর থেকে একথা জানতে পেরে ননীগোপাল মৈত্র তাঁর ভাই শঙ্করাচার্য মৈত্রের সঙ্গে স্বদেশি কালি তৈরির উদ্যোগ নেন। দুই ভাইয়ের উদ্যোগে বিদেশী কলমের কালি বর্জন করে স্বদেশি কালি তৈরির লক্ষ্যেই ১৯৩৪ সালে যাত্রা শুরু হয় সুলেখা কালির। বাংলা তো বটেই, একটা সময় দেশজুড়ে সুলেখা কালির একচেটিয়া ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। যাদবপুর-সহ দক্ষিণ কলকাতার প্রায় সকলেই সুলেখার মোড় চেনেন। কেন এই এলাকার নাম ‘সুলেখার মোড়’ বা ‘সুলেখা’ হল তা জানেন কী? একটা সময় এখানেই ছিল সুলেখা কালি তৈরির কারখানা।
সে সময় এই কালির চাহিদা এতটাই বাড়ে যে বাংলার বাইরেও সুলেখা কালির উৎপাদন শুরু হয়। ‘স্বদেশি কালি’ বার্তা নিয়েই যাত্রা শুরু হয় এই সংস্থার। এই কালি দিয়ে সুন্দর লেখা যায়, তাই ‘সু’লেখা। নাম রেখেছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী।
পরে এই কালির জনপ্রিয়তা এতটাই বাড়ে যে, সত্যজিৎ তাঁর ফেলুদার কাহিনিতে একাধিকবার সুলেখা কালির কথা লিখেছেন। ‘জনঅরণ্য’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে দেখাও গিয়েছে সুলেখা কালির দোয়াত।
স্বাধীনতা সংগ্রামী ননীগোপাল মৈত্র প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি থাকার সময় পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করেন। স্বদেশী আন্দোলনের দ্বারা তিনি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন, যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষকতার চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ তাকে ধুতির বদলে স্যুট পরে আসার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ফলে তিনি চাকরী ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং সম্পূর্ন দেশীয় উপায়ে তৈরী করে কালি বিক্রি শুরু করেন। তাঁর নামে বিভিন্ন মহলে সুলেখা কালি ‘প্রফেসর মৈত্রের কালি’ নামে পরিচিতি পায়।
কিছুদিনের মধ্যেই ফুলেফেঁপে ওঠে ব্যাবসা। পরবর্তী চার দশকে বহুগুন বৃদ্ধি পায় তাদের বিক্রি। এক সময় কোম্পানির মাসিক বিক্রি ছিল এক মিলিয়ন বোতল। সুলেখা কালি সম্পর্কে কোনও বাঙালিকে জিজ্ঞাসা করলে এখনও নস্টালজিয়ায় ভেসে যায় প্রত্যেকেই। কিন্তু ১৯৮৯ সালে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়। উৎপাদন ফের শুরু হয় ২০০৬-এর শেষে।
যদিও ননীগোপালের নাতি, সুলেখা ওয়ার্কস লিমিটেডের বর্তমান এমডি কৌশিক মৈত্রর কথায়, “আমরা কখনোই কালি উৎপাদন বন্ধ করিনি। কিছু সময়ের জন্য উৎপাদন সীমিত ভলিউমে করা হচ্ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে, ফাউন্টেন পেনের চাহিদা বাড়ছে। কারণ মানুষ প্লাস্টিকের জিনিস থেকে স্যুইচ করতে চায়। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও এই প্রচারই চালাচ্ছি। আমরা বিভিন্ন স্কুলের সঙ্গেও কথা বলছি যারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফাউন্টেন পেন চালু করতে চায়।”