বিশেষ প্রতিবেদন: আমার ছেলেবেলা কেটেছে খুলনায়। আমরা পূর্ববঙ্গের মানুষ। দেশভাগের পর এপারে চলে আসি। তখন আমার ৯ বছর বয়স। ওই ৯ বছর বয়স অব্দি পুজোটাকে বেশ ভাল ভাবে উপভোগ করেছি। আজকের পুজোর তুলনায় সেগুলো অনেক ছোট ছিল। তবে সেই পুজো ঘিরে আনন্দ ছিল দারুণ। আমাদের বাড়ির সামনে পুজোর বাজার বসত। দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে সেখানে কেনাকাটা করতে আসত লোকজন। পাঁপরভাজা হত, জামাকাপড়-খেলনাপাতির দোকানপাট বসত।
অন্যরকম পুজো ছিল সেটা! পারিবারের সবাই যোগ দিতাম। বেশ একটা উৎসবের মেজাজ ছিল। এখানে এসে ঘটনাচক্রে সেই পুজোটা আর পাইনি। সেই পুজোটা হারিয়ে যাওয়ায় আমাদের বাড়িতে আর পুজোর কথাও ওঠে না আজকাল। এই কারণেই কলকাতার পুজো আমি কোনও দিন দেখতে যাইনি। কোনও দিন কোনও ঠাকুর দেখিনি এখানে এসে। এ কথা আমি আগেও নানা জায়গায় বলেছি।
তখনকার পুজো ঘিরে একটা পারিবারিক চিত্র গড়ে উঠত ছোটবেলায়। সেই পারিবারিক চিত্রের সঙ্গে আজকের পুজোকে মেলাতে পারি না। ফলে, আমাদের কেউই এখন আর সেইভাবে পুজো দেখতে উৎসাহী নয়। আমার ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিলেন, তিনি দুর্গার মুখই দেখতেন না। তাঁর এত অভিমান ছিল মা দুর্গার ওপর। দেশহারা হতে হয়েছিল তো! দেশভাগের পর আমরা খুলনা থেকে এখানে এসেছিলাম।
দুর্গা পুজোর সঙ্গে আমার জড়িয়ে থাকা বলতে শারদীয়া সংখ্যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। পুজোর সময় কিছু পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়। আগে বেশি লিখতে পারতাম। এখন অবশ্য লেখাও কমিয়ে দিয়েছি। পুজোর ঘিরে আমার নানা লেখা প্রকাশিত হয়। খুব ব্যক্তিগত কথা কখনও লেখার সুযোগ হয়নি।
কয়েকবার পুজোর সময় বিদেশে থেকেছি। ২০১৮ সালে পুজোর সময় লন্ডনে ছিলাম। আমার সঙ্গে আমার মেয়েও গিয়েছিল। লন্ডনের পুজো অনেকটা আমাদের দেশীয় পুজোর মতো। পুজো ঘিরে সেখানকার মানুষের উন্মাদনা-ভালবাসা দেখে আমার খুব ভাল লেগেছিল। সেখানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পুজো দেখতে যাওয়ার হিড়িক নেই! পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকাই সেখানকার মানুষের মূল উদ্দেশ্য।
আমার মনে হয়েছে মেজাজের দিক থেকে লন্ডনের পুজো অনেকটা খুলনার পুজোর মতো। সাদা চোখে দেখতে গেলে হয়তো মিল পাওয়া যাবে না। কিন্তু, মেজাজের দিক থেকে অবশ্যই ওই দুই পুজোর মধ্যে মিল রয়েছে। তাই গতবার পুজোর সময় লন্ডনে গিয়ে আমি আমার শৈশবের পুজোয় মিশে গিয়েছিলাম।
এখানে থাকলে আমি পুজোর সময় মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে না গিয়ে বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে আড্ডা দিতে যাই। সে রকম একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। এবার অষ্টমীর বিকেলে সুরকার দেবাশিস দাশগুপ্তর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা হয় বিভাসদার বাড়িতে। বিভাসদা মানে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী। বিভাসদাও খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ। আমাদের তিনজনের আড্ডা বিকেল গড়িয়ে রাতের দিকে পৌঁছে যায়। অনেক খাওয়াদাওয়া হয়। এইসব আড্ডাই আসলে স্মৃতি।
আগে যখন বেলগাছিয়ায় থাকতাম, সেখানে আরেক ধরনের বন্ধুরা ছিল। তাঁরাও থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত। পুজোর সময় বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতাম। আমার ভাই অমর মিত্র একজন পরিচিত লেখক। লেখার জন্য সে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে। আমাদের দুই ভাইয়ের লেখাই নানা পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পুজোর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে রেডিও সেন্টারেও গিয়েছি। পুজোর সময় নিজেদের লেখালিখি ছাড়াও অনেকের নতুন লেখা পড়ার জন্য আমি ছোটবেলা থেকেই অপেক্ষা করে থাকি। আমাদের ছোটবেলায় যুগান্তর পত্রিকার দারুণ শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশিত হত।
একটা মজার ঘটনা বলি। পুজোর সময়ও তো আমরা নাটক নিয়েই থাকতাম। দুপুরবেলায় পাবলিক স্টেজে থিয়েটার শুরু হত। ‘দম্পতি’ বলে একটা নাটক করতাম। আমি তাতে অভিনয় করতাম। ঠাকুর তো দেখতাম না। অভিনেত্রীরা দুটো-আড়াইটের সময় সেজেগুজে আসত। এসে থিয়েটারের জন্য মেকআপ নিত। তারপর নাটক শেষ হলে ফেরার সময় আবার নতুন শাড়ি পরে ঠাকুর দেখতে বেরতেন। সেটা এক ধরণের হাসির খোরাক ছিল আমাদের।
শরৎকালে দলের থিয়েটার করতে বাংলার নানা জেলায় যেতে হত। তবে বাইরে গিয়ে থিয়েটার করার পর ক্লান্ত হয়ে আর ঠাকুর দেখতে বেরতে ইচ্ছে করত না। নিজেদের থিয়েটার করাই আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠত। কয়েকবার পুজো উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। কিন্তু, ফর্মাল উদ্বোধন করতে আমার ভাল লাগে না। তবে একেবারে অল্পবয়সী বন্ধুদের অনুরোধে দু-একবার কলকাতার পুজো উদ্বোধন করতে হয়েছে। ওই উদ্বোধনটুকু করেই আমি বাড়িতে চলে আসি। না, পুজো ঘিরে আমি কোনও দিন আলাদা করে প্রেমে পরিনি।