সে মাঠে দাঁড়িয়েছিল, সন্ধ্যায়, লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে; ইশিতা আসবে, ইশিতা এলে তার ভালো লাগে।
অনেকেই আসে ভাব জমাতে, কেউ কেউ রাতে মেসেঞ্জারে টুইট টুইট করেও অজ্ঞাতে ছেড়ে দেয় পিঁপড়ে; সে লেখে তার মুখস্ত কথাটি, এখনকার মনের কথাও বোদলেয়ারের ভাষায়, আমি ভালোবাসি মেঘ, আশ্চর্য মেঘ, ওই উঁচুতে।
এর মানে, মানুষের মাথার উপর দিয়ে আরও আরও উঁচুতে সে চোখ রেখেছে, বা রাখে, এজন্য যে নারীতে পুরুষে এইসব খেলায় অনেক অপচয় হয়ে গেছে সময়। রহস্য যাকে ভেবেছিল তা পাকা ডালিমের মতো ফেটে দগ্ধ উঠোনে রক্তরঙে রাঙানো নদী হয়ে গেছে; চেনা, খুব চেনা নদী।
ইশিতাকে সে ফোন করে না, সে জানে যাবার বেলায় একবার ঢুঁ মেরে যাবে।
ইশিতারও সামনে আছে বহু বাড়িয়ে রাখা হাতের গুচ্ছ গুচ্ছ আঙুল। সে কখনও তা ছোঁয়, কখনও ছোঁয় না।
সে কি ইশিতাকে পেতে চায়? পেতে চাওয়া মানে কি জুনের তপ্ত রোদে পুড়ে পুড়ে তার শীতল ফেনায় শরীরে শরীর ঘষে সুখী হওয়া?
এমন তো সে প্রায়ই করে, প্রতিদিনই করে, বারবার করে, ঘুরেফিরে করে, নিজের সঙ্গে নিজে করে।
তবু সে নিজের কাছে জানতে চাইলো সে কী করবে? ইশিতাকে বলবে?
রাতে ছোট ছেলেটার ডায়পার বদলাতে গিয়ে তার ঘুম ছুটে গেছে। মোবাইল ফোনের স্ক্রিন জীবন্ত করে দেখে রাতের দ্বিতীয় ভাগ কেবল শুরু হয়েছে। বিছানায় ছটফট না করে সে স্ট্যাডিতে গিয়ে অনেকদিন ফেলে রাখা উপন্যাসের শেষ লাইনের উপর কার্সর রেখে ইশিতার কথা ভাবে।
ঝনঝন আয়না ভেঙে পড়ার শব্দে স্ট্যাডির দরোজায় এসে রূপা আর্তনাদ করে দাঁড়ায়, ‘বাবা কী হয়েছে তোমার? কী করে ভাঙলো?’ রূপার পেছনে বেলা চোখের পাতায় ইরেজারের মতো আঙুল ঘষতে ঘষতে হয়ত স্যাভলন আনতে ভেতরে গেছে।
‘না, খুকু কিচ্ছু না। হঠাৎ আয়নাটা ভেঙে পড়লো।’
সে আয়নার টুকরো-টাকরোর মধ্যে নিজের মুখ স্পষ্ট করে খুঁজলো, রূপাকেও খানিকটা দেখতে পেলো।
‘যাও শুয়ে পড়ো, আমি আসছি।’
রূপা তার মায়ের ডাক্তারীর দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে সময় বেলার কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে উপন্যাসের শেষ প্যারাটি শব্দ করে পড়লো, ‘দিলারা ভেবেছিল সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় কোনোদিন হঠাৎ জানালার কাঁচ তার মাথায় ঢুকে গেলে ডাক্তার তাকে কোনো একটি স্যানাটোরিয়ামে এই ঋতুটা কাটানোর পরামর্শ দেবে। কিন্তু স্যানাটোরিয়াম তো ইউরোপের বিষয়। বাংলার এই জটাজটের ভেতরে…’
বেলা ও রূপা ঘুমাতে চলে যায়।
সে ঘুষি মেরে আয়ানা ভেঙে নিজেকে কী বোঝাতে চায়?
সে ইশিতাকে চায়?
ইশিতার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের তরমুজগোলা অন্ধকারে ডুবে থাকতে চায়?
যখন সে স্বপ্ন আর জাগরণের দ্বিধায় থাকে, তাকে আয়না ভাঙতে হয়। নিজের রক্ত দিয়ে তার জেগে থাকার, সচেতন থাকার স্বাক্ষর এঁকে নেয়।
কোনো ভণিতা না করেই মাঠের মেলা ভেঙে গেলে ইশিতার ড্রইংরুমে বসে সে বলে, ‘আমি সম্ভবত আপনার প্রতি অনুরক্ত হয়েছি। এমনটা হওয়া আমার উচিত কিনা জানি না। বা আপনি অসম্মত হলে আমি আগের অবস্থায় ফিরেও যাবো। বা আমার মনে হয় এই জাতীয় সম্পর্ক বরং যাতনাই বাড়ায়।’
ইশিতা তার আঙুলের ভেতর আঙুল রেখে জানালায় ডাল কুত্তার মতো অস্থির পর্দাটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমাদের মনে হয় ভালোই হবে।’
কিন্তু সে যে বয়সে এবং ইশিতা আরও যতখানি বেশি তারও চেয়ে, তাতে এই প্রেম ওষুধের গন্ধের মতো উত্তেজনাহীন। কিন্তু তারা বিছানায় ডুবে যেতে চায়। পরস্পরের অন্ধকার বিছিয়ে শুয়ে থাকতে চায়।
এরই মধ্যে ইশিতা দু’দফা হাসপাতালে থেকে এসেছে। মাঝে মাঝে ফোন করে কেবল আর্তনাদ করে বলে, ‘আমার মাথাটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
এই বয়সের যা যা অসুস্থতা তা তার আছে, উপরন্তু কোনো ছুতোয় রোদের মধ্যে রিকশায় ঘোরাঘুরি করে বাড়িয়ে তোলে মাইগ্রেনের ব্যথা।
সে নিজের উদ্বেগ চেপে রেখে বাইরে সহজ থাকে। ইশিতার জন্য তার কিছুই করার নেই। তার যে লড়াই, বা বলা যায় যে গহ্ববর, তাতে সে নেমে কোনো কূল পাবে না। তারচেয়ে তার ফোটা ফুলটুকু নিয়ে ঝরে পড়বার আগে স্তব করা বরং ভালো।
তাদের অবস্থানগত জটিলতায় তারা না কোনও বন্ধুর ডেরায় উঠতে পারে, না হোটেলে, উপরন্তু মারীর প্রকোপে তারা দুজনই ট্রমায়। তবু সে ভাবে, হয়ত ইশিতার আগ্রহের অভাবেই তারা মেলাতে পারছে না তাদের মর্ম।
সে জানতে চাইলে বলে, ‘আমি শূন্য। আমি শূন্য।’
স্পর্শে একটু সে কেঁপে উঠলেও তা নিতে না পারার অক্ষমতা বা হয়ত ভাবে শেষবেলায় এসে নতুন করে কিছুই আর শুরু করা যায় না। মানুষের ছায়া পড়লেও তা পাথরের মতো ঘন না হলে সে ছায়ায় দাঁড়ানো মানে রোদের চোখ ফেঁটে দুনিয়াকে দেখানো। আর তাতে ভেসে যাবে দুজনারই খড়কুটো, যা আছে মুঠোয় সামান্য।
*
ঝেঁপে বৃষ্টি নামায় রিকশা-গাড়ি নেকড়ের মতো লেজ গুটিয়ে পালাতে শুরু করলে তারা রাস্তা থেকে উঠে ফুটপাথের টং দোকানের ভেতরে এসে দাঁড়ায়।
মেঘের ভেতর লুকানো কামানগুলো কেবল মুহুর্মুহু ফাটছে।
রাস্তায় কেবল জলের ঢল ছাড়া কিছু নেই।
হয়ত ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কোমর পর্যন্ত জল জমে যাবে।
তারা এখনি হাঁটা শুরু করলে, বা নিদেনপক্ষে ইশিতার বাড়িতে পৌঁছুতে পারবে ভয়াবহ জলজটের আগেই। কিন্তু তারা অন্ধকারে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন বাইরে ভেজানোর জন্য তার মরুচারী উটের মতো হৃদয় দুখানা ভিজতে দিয়েছে। ভেজা শেষে হলে গুটিয়ে নেবে।
অরিত্র বলে, জানেন, এমন পরিস্থিতেই রবীন্দ্রনাথের একরাত্রি গল্পে অভিসার হয়। কীভাবে কী করেছে তাই ভাবছি।
‘রবীন্দ্রনাথ কী লিখেছে আমার ঠিক মনে নেই।’ বলে সে গুনগুন করে আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরাণসখা বন্ধু হে আমার…
অরিত্র ইশিতার পেটে হাত বুলিয়ে বললো, কিন্তু আমরা যা লিখবো তা তো এখনই রচনা করতে পারি।
ইশিতা চমকে ওঠে, মাথা খারাপ?
যথেষ্ট খারাপই আছে। তাছাড়া প্রকৃতি এই-ই চায়।
ইশিতা আতঙ্কিত হয়, এর মধ্যে সম্ভব নাকি?
অরিত্র হেসে বলে, টেস্ট ম্যাচ আর টি টুয়ান্টির মধ্যে পার্থক্য ও উত্তেজনা আলাদা আলাদা থাকবে না!
অরিত্র হঠাৎ নিজের হাঁটুর উপর বসে ইশিতার শাড়ি তুলে তার আনন্দকুঞ্জে বৃষ্টি ও ঘামের গন্ধে ঠোঁট ছোঁয়ায় তীব্র চুমোয়।
ইশিতার জল ফুঁসে ওঠে, যেন তার নিঃশ্বাসের এলোমেলো হাওয়ায় উড়তে শুরু করবে এক লক্ষ নিউজপ্রিন্ট।
সে আর্তনাদ করে বলে, ‘না, উঠে আসো। উঠে আসো।’
সে বাধ্য ছেলের মতো উঠে এসে বলে, অন্তত হৃদয়ে হৃদয় মেশাও।
ইশিতা তাকে বুকে চেপে ধরতে গেলে সে বাধা দিয়ে বলে, ‘না এভাবে নয়, টাটকা বুকের সঙ্গে বুক মেলাতে চাই।’
ইশিতা একটানে ব্লাউজের বোতাম ছিঁড়ে অরিত্রর টিশার্ট গোটানো বুকে বুক রাখে।
সে তার কানে ঠোঁট রেখে বলে, তুমি চাও না কেনো?
ইশিতা তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, না, আমি শূন্য, আমি শূন্য।
সে একা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সিগারেটের নিকোটিনের ভেতর। তার রক্তের ভেতর পিতলের ঘণ্টায় ধনিত হয়, আমি শূন্য, আমি শূন্য।