তালিবানদের দখলে চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের মানুষের জীবন মাঝখানে আটকে গিয়েছে। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি তার লোকদের তালিবানদের হাতে তুলে দিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। ঠিক এই সময় তার মেয়ে মরিয়ম ঘানি নিউ ইয়র্কে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন।
‘দ্য নিউইয়র্ক পোস্টে’র রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪২ বছর বয়সী ঘানি-কন্যা মরিয়ম ব্রুকলিনের ক্লিনটন হিলের পাড়ায় থাকেন। তাঁর আমেরিকায় জন্ম এবং পড়াশুনা৷ মরিয়ম পেশায় একজন শিল্পী এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। মরিয়ম আফগানিস্তানের মহিলাদের থেকে একেবারেই আলাদা জীবনযাপন করে। ২০১৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস মরিয়মের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত মেরির বাড়ির তাক বইয়ে ভরা। তাঁর বাড়িতে সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে বালিশ এবং তাঁর বাবার দেওয়া তুর্কমেনিস্তান থেকে গালিচায় মোড়া নিউ ইয়র্কের বিলাসবহুল আবাস৷

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মরিয়ম তার ফ্রিজ থেকে শুরু করে সমস্ত সামগ্রী ম্যাগনেটিক মোটিভেনসাল কোটস দিয়ে সাজিয়েছেন৷ তাঁর রান্নাঘর সবুজ টমেটোতে ভরা ছিল। সেই সময়ে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে, মরিয়ম তার জীবনধারা সম্পর্কে কথা বলার সময় নিজেকে ‘ব্রুকলিন ক্লিশ’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
বর্তমানে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন মরিয়ম। তিনি আমেরিকার মানুষকে আফগানদের অধিকারের জন্য রুখে দাঁড়ানোর জন্য সচেতন করছেন। এই জন্য তিনি একটি বিশেষ প্রচারণাও চালাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করে মরিয়ম জানতে চেয়েছেন, ‘আফগানদের সাহায্য করার জন্য আমরা এখন কী করতে পারি?’

মরিয়ম বলেছেন, তিনি তার পরিবার, বন্ধু এবং আফগানিস্তানে বসবাসকারী সহকর্মীদের নিয়ে চিন্তিত। মরিয়ম আফগানদের জন্য বিশেষ অভিবাসন ভিসা ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টায়ও কাজ করছেন। আরেকটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘গত কয়েক দিনে যারা সংযমী দেখিয়েছে, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছ থেকে যা সম্ভব, আমি অবশ্যই তা করব।
ব্রুকলিনে জন্ম নেওয়া ঘানি-কন্যা মেরিল্যান্ডে বেড়ে ওঠেন এবং তার কর্মজীবন শিল্প ও শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। মরিয়ম নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যানহাটনের স্কুল অফ ভিজ্যুয়াল আর্টসে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর কাজ লন্ডনের টেট মডার্ন এবং নিউইয়র্কের গুগেনহাইম এবং এমওএমএ -এ বিশ্বের অনেক জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছে। ২০১৮ সালে তিনি ভারমন্টের বেনিংটন কলেজে অনুষদ সদস্য হন। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবাসে বেড়ে ওঠা মরিয়ম ২০০২ সালে প্রথমবার আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন৷ যখন তার বয়স ছিল ২৪ বছর। তবে, তাঁর শিল্প আফগানিস্তানে অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে।
সম্প্রতি নিউইয়র্ক পোস্টের সাংবাদিকরা তার ব্রুকলিন বাড়িতে মরিয়মের সঙ্গে দেখা করেন৷ সাংবাদিকরা আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে তার মন্তব্য চান। তবে তিনি কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি। তিনি তার বাবা সম্পর্কে কোনও তথ্য দিতেও অস্বীকার করেন৷ ২০১৫ সালের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর বাবাকে ‘অসাধারণ ব্যক্তিত্ব’ সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
মরিয়ম বলেন, তিনি বিভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে বড় হয়েছেন এবং তাঁর শিল্পের মাধ্যমে তা দেখানোর চেষ্টা করেন। ২০১৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস মরিয়মকে একজন নারীবাদী এবং কর্মী হিসাবে উল্লেখ করেছিল। সেই সময় মরিয়ম বলেছিলেন, আমি একজন শিল্পী হতে চেয়েছিলাম৷ কারণ আমি অনুভব করেছি যে, একজন শিল্পী হয়ে আমি আরও অনেক কিছু করতে পারি।
খবরে প্রকাশ, তালিবানদের আগমনের পর মরিয়মের বাবা এবং আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি কোটি কোটি টাকা এবং চারটি গাড়ি নিয়ে দুবাই পালিয়ে গিয়েছেন। যদিও একটি ভিডিওর মাধ্যমে ঘানি এই সব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁকে “মানবিক কারণে” দুবাইয়ে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। গণি বলেন, দেশকে রক্তপাত থেকে বাঁচাতে তিনি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
]]>তাতে বিশ্বকে উদ্দেশ্য করে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি যদি কাবুলে থাকতেন তাহলে সেখানে গণহত্যা হত। নিরাপত্তার কারণে তিনি দেশ থেকে দূরে রয়েছেন। আশরাফ ঘানি দেশ ছাড়ার সময় তাঁর হেলিকপ্টারে নগদ টাকা ভর্তি করার খবরও অস্বীকার করেছেন৷ কিন্তু জায়গার অভাবে রানওয়েতে নোট ভর্তি কিছু ব্যাগ রেখে যেতে হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি টাকা নিয়ে পালিয়েছি৷ এটি একটি গুজব’।
আশরাফ ঘানি বর্তমানে আবুধাবিতে আছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) তাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। এটি সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার নিশ্চিত করেছে। এমনকি তালিবান কাবুলে পৌঁছার আগেই ঘানি দেশ ত্যাগ করেছিলেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারি সংবাদ কমিটি ‘ডব্লিউএএম’ বুধবার এক সংবাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করেছে৷ তবে তারা নির্দিষ্ট করেননি যে, ঘানি দেশের কোথায় ছিলেন। এতে দেশটির বিদেশ মন্ত্রণালয়ের এক লাইনের বিবৃতি উদ্ধৃত করা হয়েছে।
আফগানিস্তান ছাড়ার পর তার প্রথম বক্তব্যে আশরাফ ঘানি রোববার ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, তাঁর সামনে দুটি কঠিন পরিস্থিতি ছিল৷ প্রথম, সশস্ত্র তালিবানরা রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করছিল৷ দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর প্রিয় দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন৷ যা তিনি তাঁর জীবনের 20 বছর রক্ষা করেছিলেন।
তিনি আরও বলেছিলেন, “যদি আবার দেশের অগণিত সংখ্যক নাগরিক শহিদ হন এবং কাবুলে ধ্বংসই একমাত্র ধ্বংস, তাহলে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের শহরের জন্য এর পরিণতি খুবই বিপর্যয়কর হত। তালিবানরা আমাকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তারা এখানে এসেছে কাবুল এবং কাবুলের জনগণের উপর হামলা করতে। তাই রক্তপাত এড়াতে, আমি দেশ ছেড়ে দেওয়া উপযুক্ত বলে মনে করেছি। “
রবিবার রাতে ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, তিনি একটি কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়েছিলেন৷ তিনি কি সশস্ত্র তালিবানের মুখোমুখি হবেন? নাকি যে দেশের জন্য ২০টি বছর দিয়েছেন, সেই দেশ ছেড়ে যাবেন। তিনি লিখেছেন, ‘’আমাকে সরিয়ে দিতে তালিবানরা পুরো কাবুল ও বাসিন্দাদের ওপর হামলা করতে এসেছে। রক্তপাত এড়াতে দেশ ছেড়ে যাওয়া ভালো হবে বলে আমি মনে করেছি,’’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘’তরবারি আর বন্দুকের ওপর নির্ভর করে তারা বিজয়ী হয়েছে। এখন আমাদের দেশবাসীর সম্মান, সম্পদ আর আত্মমর্যাদা রক্ষার দায়িত্বও তাদের,’’ তবে আশরাফ গনি তাজিকিস্তান নাকি উজবেকিস্তান গিয়েছেন, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করা ৭২ বছর বয়সী আশরাফ গনি দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়েছেন। ২০০১ সালে তালিবানের পতনের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০১৪ সালে তিনি প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য পুনঃনির্বাচিত হন।
এদিকে সোমবার তালিবান নেতারা আফগান বাসিন্দাদের ক্ষতি না করতে মুজাহিদিনদের নির্দেশন দিয়েছে৷ কাবুলের এক বাসিন্দাআয়শা খুররম একটি টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, আজ সকালে তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন তাদের বাসার দরজার বাইরে চিৎকার আর গুলির শব্দ শুনে।
The Islamic Emirate has ordered its Mujahideen and once again instructs them that no one is allowed to enter anyone's house without permission. Life, property and honor of none shall be harmed but must be protected by the Mujahedeen.
— Suhail Shaheen. محمد سهیل شاهین (@suhailshaheen1) August 16, 2021
তিনি বলছেন, মানুষজন বলাবলি করছিল যে, মুজাহিদিনরা ঘরে ঘরে গিয়ে গাড়ি এবং ধনসম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু যখনি তারা শুনতে পেয়েছে যে, তালিবান কর্মকর্তারা আসছে, তারা দৌড়ে পালিয়েছে।
এর মাত্র এক ঘণ্টা আগেই তালিবান পুনরায় নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছে যে, তারা আফগান বেসামরিক নাগরিকদের কোনরকম ক্ষতি না করার জন্য যোদ্ধাদের নির্দেশ দিয়েছে। উল্লেখ্য, কাবুলে প্রবেশের সময় তুলনামূলক উদার মনোভাব প্রদর্শন করেছে তালিবান।
]]>তালিবান যোদ্ধারা ঝটিকা অভিযানে আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকার দখল নেওয়ার পর রবিবার তারা কাবুল শহর ঘিরে ফেলে। এরপর থেকেই পদত্যাগ করার জন্য আশরাফ গনির ওপর চাপ বাড়ছিল। আশরাফ গনি একটি বিমানে করে তাজিকিস্তান চলে গিয়েছেন বলে রয়টার্স সহ কিছু বার্তা সংস্থা রিপোর্ট করেছে। আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এককর্মকর্তাও একথা বলেছেন।
তবে আফগান প্রেসিডেন্টের অফিস বলেছে, নিরাপত্তার কারণে তারা আশরাফ গনির গতিবিধি সম্পর্কে কিছু বলতে পারছে না। রয়টার্স এই কথা তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে৷
এদিকে, তালিবানরা আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর থেকেই কাবুলে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ রাজধানী শহর কাবুলের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলি চলার খবর জানাচ্ছে রয়টার্স সংবাদ সংস্থা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই খবর জানাচ্ছে সংবাদ সংস্থাটি৷
অন্যদিকে তালিবানের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা মহিলাদের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাবেন। মুখপাত্রটি বলেন, মহিলাদেরকে একা বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হবে৷ তাদের শিক্ষা ও কাজের সুযোগও বহাল থাকবে। মনে করা হচ্ছে, তালিবানকে নিয়ে সারা বিশ্বে যে উদ্বেগ রয়েছে তা অবসানের জন্যই এ বিবৃতি।
তবে ইতিমধ্যে তালিবানে দখলে চলে যাওয়া কান্দাহার থেকে খবর পাওয়া গিয়েছে, সেখানে ব্যাংকে কর্মরত মহিলাদের বলা হয়েছে, এখন থেকে তাদের জায়গায় কাজ করবে পুরুষ আত্মীয়রা। আফগানিস্তানের অন্য জায়গা থেকেও মেয়েদের বাইরে যেতে না দেওয়ার এবং বোরকা পরতে বাধ্য করার খবর এসেছে।
রবিবার টোলো নিউজ নামে আফগান বার্তা সংস্থার প্রধান লোৎফুল্লাহ নাজাফিজাদা একটি ছবি টুইট করেছেন – যাতে দেখা যাচ্ছে যে কাবুলের একটি দেওয়ালে থাকা মেয়েদের ছবি সাদা রঙ দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন একজন লোক। তালিবান মুখপাত্র আরও বলেছেন, সংবাদ মাধ্যমকে অবাধে সমালোচনা করতে দেওয়া হবে৷ তবে তারা ‘চরিত্র হননে’ লিপ্ত হতে পারবে না।
দেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েই আফগানিস্তানে তালিবানরাজ শুরু হয়েছে৷ কাবুলের পুল-ই-চরখি কারাগার থেকে তালিবান বন্দীদের মুক্তি দেয়ার ছবির ফুটেজ অনলাইনে পোস্ট করেছে তালিবান সমর্থক একটি সংবাদ সংস্থা। এটি আফগানিস্তানের সর্ববৃহৎ কারাগার। রবিবার আরও আগের দিকে তালিবান সৈন্যরা বাগরামে আমেরিকান সমারিক ঘাঁটির সেনা কারাগারের দখল নেয়। বাগরাম কারাগারে পাঁচ হাজার বন্দী ছিল৷ তাদের মধ্যে ছিল তালিবান সদস্য, উগ্রপন্থী যোদ্ধা এবং ইসলামিক স্টেটের সদস্য। তাদেরও মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে৷
]]>