Literature – Ekolkata24: Latest Hindi News Updates from Kolkata – Breaking Stories and More https://ekolkata24.com Stay updated with Ekolkata24 for the latest Hindi news, headlines, and Khabar from Kolkata, West Bengal, India, and the world. Trusted source for comprehensive updates Sun, 21 Nov 2021 05:11:12 +0000 en-US hourly 1 https://ekolkata24.com/wp-content/uploads/2024/03/cropped-ekolkata24-32x32.png Literature – Ekolkata24: Latest Hindi News Updates from Kolkata – Breaking Stories and More https://ekolkata24.com 32 32 দুটি কবিতা | ব্রহ্মজিৎ সরকার https://ekolkata24.com/uncategorized/poems-of-bramhajit-sarkar Sun, 21 Nov 2021 05:11:12 +0000 https://ekolkata24.com/?p=11916 রাস্তা পেরলেই তোমার বাড়ি

রাস্তা পেরলেই তোমার বাড়িটা চকচক করে
দু’পা হাঁটলেই গেটের সামনে পৌঁছে যাওয়া যাবে

অথচ নড়বড়ে মন নিয়ে এগতে পারি না

একঝাঁক মেঘ নিয়ে ধবধবে বক উড়ে যায়
আমাকে পাশকাটিয়ে তোমার ছাদে গিয়ে বসে
তোমার ছাদে ওড়ে রঙে মাখা প্রজাতির দল
ছুটে গিয়ে মুঠো মুঠো ভরে নেব বুকের পকেটে

ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে এগনোর সাহস করি না

এক বুক বৃষ্টি

রাত বারে বৃষ্টি বারে
পুকুর যুবতী হয়
পাকা কাঁঠালের মত

কানা গলি ঘাপটি মেরে থাকে
রামধনু ফোটে,
দেখা যায় না তো!

পারা জুড়ে চুপ ছবি
মা-বাবা-রা টুরে যাওয়া পাখি

বুক ভরা ছুটন্ত ব্যাধ
তীর বিদ্ধ
মরে বেঁচে আছি

বেঁচে আছি অজুহাতে শুধু
গুরু ঠাকুর
এ কেমন নদী?

তুমি ছিলে বলে পার হয়ে যাব
এ আমার বিপুল জলধি..

]]>
লেখো তুমি | রিনা গিরি https://ekolkata24.com/uncategorized/poem-og-rina-giri Sun, 21 Nov 2021 05:00:51 +0000 https://ekolkata24.com/?p=11914 লিখবে না! তুমি লেখো। লেখো তুমি…
আমার কলম বন্ধ্যা হলে আগের মতো
তোমার কী খুব কষ্ট হবে?
হাতের মুঠো আলগা করে
কোথায় যেতে চাইছ বল
ছেড়ে যাচ্ছে কতো কতো বন্ধু…
ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে এখন
আকাশ দেখছি উদাস চোখে
পথ চলতি মানুষগুলো
ছুটছে কেবল এদিক ওদিক–
হঠাৎ আকাশ কালো করে
চমকে দিচ্ছে সন্ধে বেলা
এমন সময় থাকতো যদি
আমার কাঁধে তোমার হাত
আমার কলম বন্ধ্যা হলে
ভেবেছিলাম খুশি হবে
সে যে কেবল আমার মনের ভুল
এই কথা তার আজ জেনেছি যখন
জন্মদিনের ঝগড়াঝাটি এক নিমেষে…
এই তো বলছি আমি
তুমি লেখো চরণদাস লেখো তুমি…

]]>
এ সপ্তাহের গল্প: অভিমান https://ekolkata24.com/uncategorized/story-of-jugal-pandit Sun, 21 Nov 2021 04:53:29 +0000 https://ekolkata24.com/?p=11910

যুগল পণ্ডিত

হাবুল মরে গিয়েছে গত শীতে। বীরেনও কিছুদিন আগেই এই শীতে।
মুখটা ফ্যাকাশে ছিল বীরেনের। ঘন কুয়াশায় দেখা ভাঙাচোরা বাড়ির মতো।

দাঁড়িয়ে থাকলে কুয়াশা ভেদ করে দেখা যায় না কিছু। এগিয়ে যেতে যেতেই পরিষ্কার হয়।

পেছনেও ছুটে আসে কুয়াশা।
ইউক্যালিপ্টাস গাছ, কলেজ, সরকারি ভবন–
কাছের রিট্যায়ার্ডের মাঠটাও দূরে চলে গেছে দশ বছর।

ফিরে তাকালে যতই কাছের মনে হোক, অঙ্ক বলছে অন্য কথা। সামনের দিকে তো আর নেই অনন্ত সময়।

এবার শীত জাঁকিয়ে পড়বে, সন্দেহ নেই। বিষকামড় দিতে চায় এখনই। সবে নভেম্বর।

মনে হয় সামনেই স্কুল ফাইনালের পরীক্ষা।

শীতের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহাত্মক দৃঢ়তায় হাঁটছেন এক সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধ।

ছেলে উলের সোয়েটার এনে দিয়েছে। ভেতরে উলিকট। গলায় মাফলার। মাথায় মাঙ্কি টুপি। সেও প্রচণ্ড গরম।
কান সহ্য করতে পারে না একটু হাঁটলেই।

বৃদ্ধ হাঁটার অভ্যাসটি রেখেছেন নিয়মিত। জুতো জোড়াও বেশ নরম।

সারা শহর জুড়ে পথবাতি গুলো জ্বলছে। গাড়িগুলোও ছুটোছুটি করছে। মানুষ গুলো যেন যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছে। কারও হাতের থলেতে ফলমূল। কোনও একটি মেয়ের উচ্চকিত হাসি। কোনও একটি লোক কাঁধ কুঁজো করে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাচ্ছে। দ্রুত চলে যাচ্ছে বাইক পাশ দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের মতো।
দরকষাকষি হচ্ছে ফুটপাতে।

সত্তোরোর্ধ এই বৃদ্ধ একা হাঁটছেন কেন কেউ জানে না।
কোনও কাজ নেই শহরে। নেই কোনও কেনাকাটারও দায়ভার। তবুও।

পথে কেউ কথা বলছে না।
কেউ নজরই দিচ্ছে না তাঁর দিকে।
তবে, হ্যাঁ,
হাবুল, বীরেনরা হয়তো দেখে থাকবে,
–কথা না শুনলে কেমন হয়?

–দ্যাখো শুধু হাঁটুর ব্যথার অজুহাত দিয়ে, ঘরে বসে, বৌকে দিয়ে চা করিয়ে খাওয়া?

শীতকে জব্দ করতেই হবে।
ভয় পেলে চলবে না।

]]>
এ সপ্তাহের গল্প: দীপ শেখর চক্রবর্তী https://ekolkata24.com/uncategorized/story-of-deep-sekhar-chakraborty Sun, 14 Nov 2021 05:22:21 +0000 https://ekolkata24.com/?p=11235

সুলতার ফুলছাপ সায়া

দুপুরবেলা জ্যোতির্ময় টেলিফোন করে জানালো স্যার আর নেই। আত্মহত্যা।

আত্মহত্যা!

সারা দুপুর এমন বৃষ্টি হল যেন পৃথিবী ভেসে যাবে। আমাদের বারান্দার শেষ দুটো সিঁড় জলের তলায় চলে গেছে। দেওয়ালের দিক থেকে চুইয়ে চুইয়ে জল পড়ছে। এমন বৃষ্টির মধ্যে আর স্যারের ঘাড় ভাঙা নিস্প্রাণ দেহটা দেখতে যেতে ইচ্ছে করল না। বৃষ্টি না হলে কী হত সেটা বলা শক্ত। তবে আমার যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না। ফলে বিকেলবেলা যখন জ্যোতির্ময় আবার ফোন করল তখন না যাওয়ার একটা অজুহাত হয়ে উঠল বৃষ্টি।

এমন বৃষ্টির দিনে চলে যাওয়ার কথা কী ভাবা যায়?

স্যারের কাছে আমি যবে অঙ্ক করা শিখতে যাই তার অনেক আগে থেকেই ওর সঙ্গে বাবার যোগাযোগ। বাবার ব্যাঙ্কেই একটা ঋণ নেওয়ার সূত্র ধরে পরিচয়। বাবার জন্যই সেটা পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। আমার বাড়ি থেকে স্যারের বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। মাঝে-মধ্যেই সকালের বাজার করে আমাদের বাড়িতে চায়ের আড্ডায় চলে আসত। তখন আমি প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি টপকাতে পারিনি। তখনও জানতাম না, মানুষটি একদিন আমার অঙ্ক স্যার হবে।

দূর থেকে মানুষটিকে খুব আমুদে মনে হত। নানারকম কথায় মাতিয়ে রাখত চায়ের আড্ডাটা। বহুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর আচমকা নিজেকে নিজে তাড়া দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যেত। আর একটাও কথা বলত না।

অঙ্ক করতে গেলাম যখন তখনও মানুষটা একইরকম। জ্যোতির্ময় এই অঙ্ক ব্যাচেরই সহপাঠী।

সেদিন দুপুরবেলা জ্যোতির্ময়ের মুখ থেকেই শুনলাম আমাদের অঙ্ক শেখানোর স্যার আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা মানে জীবনের অঙ্কগুলো ঠিকমতো মেলাতে পারেননি ? নাহ, এভাবে ঘটনার খুব সরলীকরণ হয়ে যাবে।

বিকেলবেলা ঘটনাস্থলে না গেলেও মাথা থেকে বিষয়টা মুছে ফেলতে পারলাম না। স্যার কখনও আত্মহত্যা করতে পারে? জ্যোতির্ময় কীভাবে ঘটনাটা জানলো সে-কথাও জিজ্ঞেস করে ওঠা হয়নি। শুধু আত্মহত্যার কথা শুনে নীরবে ফোন রেখে দিয়েছি। এমনকি বিকেলবেলা যখন ও আবার ফোন করেছিল তখনও বিশেষ কোনও কথা হল না। শুধু জানিয়ে দিলাম, এমন বৃষ্টির মধ্যে যাওয়া কঠিন।

বিকেলবেলা দোতলার ঘর থেকে পুরনো অঙ্ক খাতাগুলো নামিয়ে আনতে গেলাম। অনেক খুঁজে স্যারের খাতাগুলো খুঁজে পেলাম। এই খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সাহায্য করেছে মলাটের ওপর লিখে রাখা নাম।

স্যারের অঙ্ক খাতা

যা আশা করেছিলাম তাই। খাতার ভেতরে একটা কিছু আর লেখা নেই। সমস্ত অঙ্কগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। স্যার নিজের শেখানো অঙ্কগুলো নিজের সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন, বেশ বুঝলাম। ঠিক তক্ষুনি একটা ভয় হল আমার। পাগলের মতো পুরোনো শংসাপত্রগুলো বের করলাম।

আমি যা আশঙ্কা করছি তা যদি ঠিক হয় তবে তো মহাবিপদ।

ঠিক তাই হল। প্রতিটি অঙ্কের নম্বরের নীচে একটা লাল দাগ। সব শূন্য। স্যার শুধু অঙ্কগুলো নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শেখানো অঙ্কের সব পদ্ধতিগুলো নিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

এখন উপায় কী সেই নিয়ে কোনও ভাবনাই মাথায় এল না। আমার গোটা জীবনের সমস্ত অঙ্ক খাতাই একটা করে লাল দাগে ভরে গেছে। জীবনের প্রতিটি হিসেবেই এখন আমি অকৃতকার্য। কিছু সময় পর হয়ত এই নিয়ে একটা তোলপাড় হবে। কী কী কেড়ে নেওয়া হবে আমার থেকে তার একটা সম্ভাব্য হিসেব করে রাখলাম। দেখা গেল, কিছুই প্রায় অবশিষ্ট রইল না।

সন্ধের দিকে বৃষ্টি ধরে গেল। কোল ভর্তি ফাঁকা খাতা নিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। বেরিয়ে পড়লাম। ছায়াবাণী সিনেমা হলের কাছে চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি, রজতের সঙ্গে দেখা। রজতও স্যারের কাছে পড়া আমার সহপাঠী।

-স্যার আর নেই।

এই নিয়ে দ্বিতীয়বার স্যারের না থাকার কথা শুনলাম। প্রথমবার শুনে যতটা অসম্ভব লেগেছিল এখন ততটা লাগল না। এভাবেই মৃত্যু সয়ে যায়।

-স্যার যে আত্মহত্যা করতে পারে এ কথা ভাবতে পারি না।

আমার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল রজত। তারপর গম্ভীর ভাবে বলল –

-স্যার আত্মহত্যা করেনি দীপ। দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

দুর্ঘটনা! তবে জ্যোতির্ময় যে বলল স্যার আত্মহত্যা করেছে।

জ্যোতির্ময় কিচ্ছু জানে না। হয়ত, রজতও না। ছায়াবাণী সিনেমাহল পেরিয়ে যখন স্টেডিয়ামের পাশের পথ দিয়ে হাঁটছি মনে হল মৃত্যু সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি। কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, কেন ঘটল সেসব সম্পর্কে কিছুই আমি জিজ্ঞেস করিনি রজত কে। জিজ্ঞেস করে লাভ? তবে অদ্ভুত লাগল যখন রজত একটি পুরনো ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিল।

তোর মনে আছে পড়াতে বসে স্যার কেমন মাঝে মাঝে গা হাত পা টেপাতো মেয়েদের দিয়ে?

আচমকা মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। সেই তো, অদ্ভুত! কথাটা আজ শুনে কেমন গা ঘিনঘিন করে উঠল। তবে এতদিন চোখের সামনে দেখেছি, কিছুই তো মনে হয়নি। বরং তা এক পিতৃতুল্য মানুষের প্রতি মেয়েদের সেবা হিসেবেই দেখেছি। তবে কি আমাদের মন অনেক বেশি বিষিয়ে গেছে ?

কথাটা বলে রজত কদর্য হাসলো। ঠিক সেই মুহূর্তে রজতকে বেশি ঘৃণা করেছিলাম নাকি সদ্য মৃত স্যারকে ঠিক তুলনা করতে পারলাম না।তারপর সেই তুলনা করতে না পারাটাকে নিজের মুখের ভেতর তেতো একটা স্বাদ করে এগিয়ে গেলাম স্টেডিয়ামের রাস্তায়।

রাত্রিবেলা একটা ছোট্ট সাদা ওষুধ খাই। উদ্বেগ কমানোর ওষুধ।

তবে স্যারকে নিয়ে চিন্তা মনটাকে অস্থির করে তুলেছে। স্যারের মৃত্যু, সেটা কি আত্মহত্যা নাকি একটি দুর্ঘটনা। কিন্তু তাতেই বা কী যায় আসে? আমি ভাবছি আমার সমস্ত কীর্তি থেকে অঙ্কের নম্বরগুলো উধাও হয়ে গেছে। ফলে, এখন সমস্ত কিছুতেই আমি অকৃতকার্য। কাল কী রাষ্ট্র এসে আমাকে দেওয়া সমস্ত শংসাপত্র কেড়ে নিয়ে চলে যাবে?

তাহলে আমার পরিচয় কী হবে? এত এত বছর যে কাগজগুলো অর্জন করার জন্য সমস্ত দিয়ে দিয়েছি? সমস্তকিছুই এক মুহূর্তে মূল্যহীন হয়ে গেল? আমার অস্তিত্ব? কাল থেকে কি নতুন করে আমাকে অঙ্ক শিখতে হবে? শুয়ে শুয়ে ছোটবেলায় শেখা অঙ্কের সুত্রগুলো হাতড়াই। বারবার যোগ করে দেখি, দুই যোগ দুই কত? চার, চার, চার আর গতবার বলব?

চার!

এই শালা শুয়োরের বাচ্চা

স্বপ্নের ভেতর নাকি বাস্তবে কেউ গালাগাল করল, ঠিক বুঝতে পারলাম না। আশ্চর্য স্বপ্ন দেখছিলাম স্যার সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসে আছে আমাদের বাথরুমে। তার হাত পা টিপে দিচ্ছে আমার প্রাক্তন প্রেমিকারা। সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এই গোটা দৃশ্যটা আমরা দেখছি, বাড়ির সেই পুরোনো বড় শাটার টিভিটায়। যেখানে মাঝে মাঝেই ইঁদুর দৌড়ে যেত। বিকেলবেলা যেখানে দেখা হত ‘ জন্মভূমি ’ নামক ধারাবাহিকটি। সেই টিভিতে স্যারের নগ্ন হয়ে স্নান করানোর দৃশ্য। আচমকা তা মুছে গিয়ে জ্যোতি বসুর মুখ ভেসে উঠল। জ্যোতি বসু আমাদের সে সময়ের একমাত্র ঈশ্বর। কামান দাগার মতো করে গুড়ুম আওয়াজ হল কোথায় আর স্বপ্নের ভেতর নাকি বাস্তবে কে চিৎকার করে আমাকে গালাগাল করল-

এই শালা শুয়োরের বাচ্চা।

ধড়ফড় করে জেগে উঠে বাথরুমে গেলাম। তারপর দাঁত মাজতে মাজতে আরেকবার গিয়ে বসলাম বের করে আনা অঙ্ক খাতাগুলোর কাছে। না, এখনও খাতাগুলো ঝকঝকে পরিষ্কার। স্যার আমার সর্বনাশ করে দিয়ে গেল।

শালা মেয়েবাজ লম্পট মাল একটা।

কাগজপত্র ঘাটতে ঘাটতে এল মেঘার টেলিফোন।

-দীপ, স্যার নাকি খুন হয়েছে?

এই নিয়ে তৃতীয় বার স্যারের মৃত্যু নতুন করে আমার সামনে এল। কিন্তু মেঘা কীভাবে স্যারকে চেনে? ও তো আমাদের আমাদের সঙ্গে অঙ্ক করত না? মেঘা কোনও উত্তর দিল না। মনে হল কিছু একটা যেন চেপে গেল মেঘা।

তাহলে কি আমার জীবনের অঙ্ক না মেলার ঘটনাটা মেঘার থেকেই শুরু হল?

কিন্তু স্যারের মৃত্যু সম্পর্কে এই তৃতীয় তথ্যটা আমার বিশ্বাস হল না। খুন! যদিও তৃতীয় বারেও সেই সম্পর্কিত বিস্তারিত আমি জানতে চাইলাম না মেঘার কাছে।

আত্মহত্যা – দুর্ঘটনা – খুন

সমস্তটা যদি একটা ব্রাকেটে রেখে দেওয়া যায় তবে সূত্রটা হয় –

( আত্মহত্যা + দুর্ঘটনা + খুন ) = একটি মৃত্যু

দুপুরবেলা কাউকে না জানিয়ে গেলাম মাখন সাহার পুকুরের কাছে। স্যারের মৃত্যু সংবাদের চব্বিশ ঘন্টা কেটে গেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একটু খোলা জায়গায় যাওয়ার দরকার। চাষের জমিটাকে দেখলাম পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কী হচ্ছে?

-যা চাষের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

-মানে ?

-বলুন, জয় শ্রী…

কিছুদূর গেলেই সেলিম আলির বাড়ি। আমাদের বাড়িতে রোজ তরকারি দিতে আসত। একদিনের পর আর এল না।

কেন এল না সে প্রসঙ্গ তোলা আমাদের বাড়িতে একপ্রকার নিষিদ্ধ।

মাখন সাহার পুকুরের কাছে পুরোনো ইটখোলার ঢিবি। তার ওপরে একটা শিমুল তুলোর গাছ। বহুদিনের পুরোনো গাছ। মালাবার সিল্ক কটন। ফুলে ফুলে লাল হয়ে থাকে। এখানেই কতদিন রাতের বেলা শুয়ে থেকেছি কাউকে কিছুই না জানিয়ে।

একা একা কী আর শুয়েছি?

কতটা হুরেরা এসে শুয়েছে আমার পাশে।

হুর !

কুরআন সম্পর্কে তাফসির ও ব্যাক্যাসমূহে, হুরের নিন্মরূপ বর্ণনা রয়েছে –

১। কুমারী

২। বড় ও সুন্দর চক্ষুধারী

৩। তেত্রিশ বছর বয়স

৪। সুন্দর রঙ

৫। কোন জিন ও মানব পূর্বে যাদের ব্যবহার করেনি

৬। ইত্যাদি ইত্যাদি…

সাদা তুলো আমাদের শরীরের ওপর এসে কতদিন পড়েছে। সবই স্যারের শেখানো অঙ্কে। তবে আজ সেসব যেন মুছে গেছে পৃথিবী থেকে। একটা ফ্যাকাশে মেঘলা দিন এবং অসম্ভব অবসাদগ্রস্ত হয়ে বহুক্ষণ বসে রইলাম ঢিবির ওপরে। ভাবলাম – হুরেরা ইস্কুল, চাকরি করতে যাবে তবে আমি আর চায়ের দোকানে বা রেস্তোরাঁতে বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে পারব না। সেই সর্বনাশটাই হয়ে গেল।

আমার কাগজপত্র সমস্তই বাজেয়াপ্ত হবে কিছুদিন পর। সমস্ত শংসাপত্র কেড়ে নেওয়া হবে। তারপর পরিচয়হীন একটা জঞ্জালের মতো আমি এই পৃথিবীতে রয়ে যাব। স্যার নিজের শেখানো সমস্ত অঙ্ক নিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।

 

বাড়ি ফেরার পর বাবা দু’টো কথা বলল। ততক্ষণে জ্যোতির্ময়ের প্রথম খবর দেওয়ার চব্বিশ ঘন্টা অতিক্রান্ত।

এক, স্যার নাকি হঠাৎ বাড়ি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।

দুই, একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে বার্মা কলোনিতে।

 

স্যারকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন খবর শুনতে শুনতে আমার এখন সমস্তটাই সয়ে গেছে। নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনাটা আমাকে তেমনভাবে আর নাড়া দিল না। মনে মনে আমি একটা অঙ্ক কষে নিলাম।

( আত্মহত্যা + দুর্ঘটনা + খুন ) = মৃত্যু / নিরুদ্দেশ

 

যদিও মৃত্যু ও নিরুদ্দেশ এক কথা নয়। তবে আমার স্বার্থের দিক থেকে দেখলে দু’টোর মধ্যে কোনও তফাৎ নেই।

 

দ্বিতীয় ঘটনাটির প্রসঙ্গে আসি। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে বার্মা কলোনিতে। সেখানে একটা ছোট খাল রয়েছে যা এককালে ভয়ানক নদী ছিল। প্রবল বন্যা হত সেই নদীতে। তবে মূল স্রোতের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বহু বছর ধরে তা খাল। সেই খালের পাশেই জমিতে এককালে বার্মা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের বসিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। এভাবেই বার্মা কলোনি গড়ে উঠেছিল।

এই খাল যা এককালে নদী ছিল তার আশেপাশেই শুরু হয়েছে বিশাল ভাঙন। নদী যেন তার পুরনো রূপ আবার ফিরে পাচ্ছে। একে একে সমস্ত চলে যাচ্ছে নদীর পেটে। পৌরসভা কিছুই করতে পারবে না বলে হাত তুলে ফেলেছে ইতিমধ্যে।

আমার চিন্তা হল। এই বার্মা কলোনিতেই তো সুলতাদের বাড়ি।

সুলতা, আমার মাঝেমাঝেই রাত্রিবাসের একমাত্র ঠিকানা। ওর বাড়িটাকে বাড়ি না বলে ঝুপড়ি বলাই ভালো। তবে একটা পোক্ত টিনের চাল রয়েছে। রাতের বেলা বৃষ্টি হলে সেই টিনের চাল যেন ঝমঝম করে নাচে। সুলতার বয়েস তেত্রিশ।

সুলতার সব ভালো শুধু দু’টো বিষয় আমার একদম ভালো লাগে না।

এক, সুলতা ওর ফুলফুল সবুজ সায়াটা একদম ছাড়তে চায় না। রাতের পর রাত পরে থাকে।

দুই, মাঝে মাঝেই ওর বিরক্তিকর স্বপ্নটার কথা আমাকে শোনায়। অদ্ভুত একটা পাখি নাকি স্বপ্নের ভেতর ওর স্তন ঠোকরায়। স্বপ্নের ভেতর এসব ঢ্যামনামো আমার একদম সহ্য হয় না।

তবুও সুলতাকে আমার পছন্দ। আমাকে ওর বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার জন্য কখনোই ও শংসাপত্র দেখতে চায়নি। আমার অঙ্কের নম্বর দেখতে চায়নি। এই কালই যদি আমার কিচ্ছু না থাকে তাহলে বাড়িতে আশ্রয় পাব কিনা জানি না তবে আমি ঠিক জানি, সুলতাই আমাকে আশ্রয় দেবে।

 

সন্ধেবেলা বেরিয়ে গেলাম বার্মা কলোনির পরিস্থিতি দেখতে। দেখলাম আমাদের ছোট শহরের খালটি বিরাট রাক্ষসের মতো আকার ধারণ করেছে। দুদিকের প্রায় সব বাড়িই ওর পেটের ভেতর গেছে ঢুকে। পুলিশ লম্বা ব্যারিকেড করে রেখেছে। এদিকে পৌরসভার লোক, ইঞ্জিনিয়ার, ভূতত্ত্ববিদ সবাই সঙের মতো দাঁড়িয়ে দেখছে ধ্বংসলীলা। সেই ভিড়ের মধ্যে আমি সুলতার ঘরটা খুঁজতে লাগলাম। নাহ, আশ্চর্য ভাবে বেঁচে গেছে সুলতার ঘরটা। অদ্ভুত ,অলৌকিক যেন এই বাঁচা।

আচমকা উপস্থিত জনতার মধ্যে একটা শোরগোল ওঠে। দেখি ভিড় ঠেলে, পুলিশ ঠেলে, পৌরসভার লোক, ইঞ্জিনিয়ার, ভূতত্ত্ববিদ সবাইকে ঠেলে উপস্থিত হল একজন লম্বা চুলের লোক। শরীরে তার আশ্চর্য দ্যুতি। মাথার পেছন আলো হয়ে আছে। তার পরনে শুধু একটা সাদা রঙের ধুতি। কপালে চন্দন টিকা। সবাই ঠাকুর ঠাকুর করে চিৎকার করে উঠল।

লোকটি গেল নদীর সামনে। তারপর চোখ বুজে যেই হাত তুলল , এতক্ষণের রাক্ষুসে নদী যেন ছোট্ট বাচ্চাটি হয়ে বসে পড়ল মাটিতে।

ভিড়ের মধ্যে চিৎকার আরও বাড়তে লাগল। জয়ধ্বনি…

তারপর যে দেখলাম সেই লম্বা চুলের পুরুষ ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সুলতাদের বাড়ির দিকে। দুটো টোকা দিতেই খুলে গেল দরজা। ঢুকে গেল লোকটি ভেতরে।

দেখলাম বাইরের তারে ঝুলে আছে সুলতার বহু ব্যবহৃত ফুল ছাপ সবুজ সায়াটা।

]]>
গাড়িতে যেন নতুন করে পেট্রোল-ডিজেল দেওয়া হয়েছে: সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় https://ekolkata24.com/uncategorized/interview-of-sanjib-chattopadhyay Sun, 07 Nov 2021 06:23:57 +0000 https://www.ekolkata24.com/?p=10586 সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের সুপরিচিত নাম। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় জন্ম। মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং হুগলি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক। বহু উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধের রচয়িতা। তাঁর রচনায় হাস্যরসের সঙ্গে তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ মেশানো থাকে– এটাই তাঁর লেখার বৈশিষ্ট। ছোটদের জন্য লিখেছেন অনেক। ‘লোটাকম্বল’ তাঁকে তুমুল জনপ্রিয়তা দিয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন’ বইয়ের জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। সেই সময় এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় বরাহনগরে লেখকের বাসভবনে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অরুণাভ রাহারায়

অরুণাভ: সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেলেন। কেমন লাগছে?
সঞ্জীব: প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক। হ্যাঁ ভালোই লাগছে। বেশ একটা কেমন কেমন লাগছে। এ প্রসঙ্গে বলি– এতকাল হাতুড়ে চিকিৎসক ছিলাম তো; এবার যেন পাশকরা ডাক্তার হলাম আর কি! এর আগে অনেকেই বলতো কী কী পুরস্কার পেয়েছেন? দুঃখের সুরেই বলতাম কোনো বড়ো পুরস্কার তো পাইনি! আসলে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের কথাই সকলে শুনবে; এমন এক ট্রেন্ড আছে চিরকালই। এই পরিসরে এক মজার কাহিনি বলি। আমি এক জ্যোতিষীকে বলি আপনি তো বলেছিলেন, আমি মস্ত বড়ো পুরস্কার পাব! কোথায়? তখন তিনি বলেন, একজনের কুষ্টি দেখে বলেছিলাম– তুমি লটারিতে বড়ো পুরস্কার পাবে। সে গিয়ে পাড়ার লটারিতে এক টাকার লটারি কেনে এবং প্রথম পুরস্কার পায়। সেই পুরস্কার ছিল এক নাগড়ি গুড়! আমারও নাকি এমনই হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তুমি পাড়ার দুগ্গাপুজোয় বিচারক হয়ে গিয়ে গলায় একটা ব্যাচ ঝুলিয়ে ঘুরেছো। এতে তোমার বড় পুরস্কারের ভাগ্য নষ্ট হয়েছে! তারপর ভাবলাম পুরস্কার পাওয়ার জন্যই লিখতে হয় বুঝি!

অরুণাভ: লেখালিখির বাইরে আপনার অবসর যাপন….
সঞ্জীব: কলকাতায় এই বাড়িতে আসার পর এখানে অনেক বড় বড় গাছের সমাহার দেখা যেত! আমি এবং আমার পিতৃদেব মাটির চালুনিতে চেলে সহজেই ভূমিজাত কিছু গাছ লাগিয়েছি। এরপর কৃষ্ণচূড়া, আম, চেরি গাছ! পরবর্তীতে কেটে ফেলতে হয়! আগে মরশুমি ফুলের প্রস্ফুটনে পুরো বাগান ফুলে ছয়লাপ হয়ে যেত। এখন বাড়িতে একা হয়ে যাওয়ায় তেমন পরিচর্যা করা হয় না। এক টব এখান থেকে ওখানে সরিয়ে কেবন টব স্থানান্তরের খেলা চলে। বর্ষায় এই সব টব জলে টুইটুম্বর হয়ে যায়। এই সব গাছ এক এক স্মৃতি। বাগানে একটা গুলঞ্চ গাছ আছে। আমার বাবা গঙ্গার জল থেকে তার ডাল পুঁতেছিলেন। সেটা এখনও আমাদের বাড়িতে আছে।

অরুণাভ: আপনার কি মনে হয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেতে অনেক দেরি হয়ে গেল?
সঞ্জীব: এই আক্ষেপটা আমার পাঠক-পাঠিকাদের। যারা আমার লেখা ভালোবাসে। আমি এক বিষয় আবিস্কার করলাম, আমি মহানন্দে শুধুই লিখে গিয়েছি। সেই লেখা পাঠক-পাঠিকাদের হৃদয় জয় করেছে। তাই পুরস্কারের চিন্তা ছিল না। কিন্তু এই যে পুরস্কার এল, যেন এক প্রবল উচ্ছ্বসের মতো! পুরস্কার ঘোষণার পর সারারাত কিছু সময় ঘুমিয়েছি। যারা আরও কম বয়সে এই পুরস্কার পেয়েছে, সেই পুরস্কারে এখন ঘুণ ধরে গিয়েছে। ঘুণ ধরেছে লেখকের কর্মজীবনেও। সাহিত্য আকাদেমি পাওয়ার পর আমার মনে হল গাড়িতে যেন নতুন করে পেট্রোল-ডিজেল দেওয়া হয়েছে। এবার উদ্যোম গতিতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। হ্যাঁ, এটাই আমার বড়ো পাওয়া। বেলুড় মঠের মহারাজ এই দেরি প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন। আমি বলি, মহারাজ দেরি হওয়াই ভালো। আসলে জীবনের শেষ ভাগটা খুব শুকনো। বন্ধুবান্ধবহীন জীবনে একাকীত্ব চলে আসে। শেক্সপিয়ার বলেছেন, suns shine, sun steingth, suns availability. গৃহবন্দি জন্তু হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে এই পুরস্কারটা এলো। আমি ঠাকুরমা স্বামীজিকে বিশ্বাস করি, তাঁরাই হয়তো এটা আটকে রেখেছিল এতদিন…

অরুণাভ: শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে, ‘দেরি করে যে এসেছে, ইচ্ছে করে ভালোবাসি তাকে।’ ব্যাপারটা তেমনই তো?
সঞ্জীব: হ্যাঁ একদম। আর দেরি করে যে এসেছে সে তো যুবতী নারী, বৃদ্ধা নয়। সেই নতুন প্রেম, নতুন করে ভালোবাসা…..

অরুণাভ: আপনার লেখায় ও জীবনে রামকৃষ্ণ, সারদা মা এবং স্বামীজির প্রভাব প্রভাব লক্ষ্য করা যায়
সঞ্জীব: এ এক মস্ত বড়ো গল্প। আমি স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পাশ করে অবসর সময়ে দর্শনের অনেক বই পড়তে লাগলাম এক সময়। তার মধ্যে ছিল, ভ্যান গখের মতো দার্শনিকদের বইও। আমাদের বাড়িতে এমন শিক্ষা দেওয়া হত, যা কিছু পড়বে, পরে যেন সেটা কাজে লাগে। সেই ভাবনায় দীক্ষিত হয়ে আমি জীবনের প্রথম লেখা লিখলাম ‘মানুষ’। যার প্রথম লাইনই ছিল ‘Man is a biped without wings’। মানুষ কে যতই দেবতা করে দেখানো হোক না কেন, আসলে সে এক জন্তু! সেই লেখা রামকৃষ্ণ মিশনের কাগজ ‘উদ্বোধন’-এ পাঠাই। কিছু দিন বাদে একটি চিঠি পেলাম। তাতে আমাকে দেখা করতে বলা হয়েছে। আমি গিয়ে সম্পাদক মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। উনি তো আমাকে দেখে হেসে অস্থির। আমি ভাবছি, এত খারাপ লিখেছি যে আমাকে ডেকে এনে উনি বুঝি হাসছেন! তাঁকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম– কী ব্যাপার? উনি বললেন, তোমার প্রবন্ধ পড়ে মনে হল, তোমার বুঝি অনেক বয়স! বড় বড় চুল থাকবে, চোখে বড় লেন্সের চশমা। কিন্তু এ তো দেখছি ছোট ছেলে! এর পর তাঁর সঙ্গে সখ্য তৈরি হল। সেই আমার এই জগতে প্রবেশ। এরপর দেওঘর বিদ্যাপীঠে পড়াতে গেলাম। সেখানে যাওয়ার কারণ অবশ্য ছিল। আমি সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলাম। সে সময় এক সমস্যাও হল। কারণ, বাড়িতে বাবা ছাড়া কেউ নেই। তিনি আমার এই সিদ্ধান্ত কীভাবে নেবেন? আমার গুরুদেব বললেন, তুমি যদি বলে সন্ন্যাসী হব, তা হলে উনি হয়ত আহত হবেন। তুমি বরং বলে, ওখানে শিক্ষকতা করবে। আমি সেই মতো ওনাকে জানিয়ে দেওঘর গেলাম। কিন্তু সন্ন্যাসী হওয়া আমার আর হল না। ঢুকে পড়লাম লেখার জগতে। এই পরিবেশে আসার আগে আমাকে অনেক চাকরির গন্ডি পার হতে হয়েছে। আমাকে একজন বলেছিলেন, তুমি যত পড়বে, ততো পরিশীলিত হবে। ভালো ভালো সাহিত্য পড়লে বুঝতে শিখবে। আর সব শেষে তোমার সাহিত্যযাপনে যেন কান্না থাকে…।

অরুণাভ: সেই কান্না ছাপিয়ে আপনার লেখায় এত হাসি…
সঞ্জীব: পৃথিবীতে যখন এসেছিলাম তখন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিলাম। আর যে শিশু জন্মানোর পর কাঁদে না তাকে নিয়ে সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করে। তখন তাকে কাঁদানোর জন্য পিঠে চাপড় দেওয়া হয়- একটু কাঁদ বাছা। এক্ষেত্রে তুলসী দাস বলছেন, তুলসী যাব যগ মে আয়ো, তুলসী রোয়ে জাগ হাসে! সবাই তো খুশি ছেলে হয়েছে, ছেলে হয়েছে। কিন্তু তুলসী যগ মে যায়ো, তুলসী হাসে যগ রয়ে। অর্থাৎ তুমি জীবনটাকে এমন করো যাতে সবাই কাঁদে। এই দোঁহাই আমার জীবনে কাজে লেগেছিল। আর চারদিকে তাকাই, তখন যতই গণতন্ত্র-প্রজাতন্ত্রের বুলি আওরালেও জগতে একটা কথা আছে Have’s ও Havesn’t. মানে এক শ্রেণীর মানুষ খেয়ে শেষ করতে পারছে না, আর এক শ্রেণীর মানুষ দু’বেলা খেতেই পারছে না। আর যারা খেয়ে শেষ করতে পারছে না, তারাই গণতন্ত্রের মাথায় বসে আছে। তাদের মুখে বড় বড় কথা। এক্ষেত্রে আরও এক কথা বলি। আমি প্রচুর শ্রুতি নাটক করতাম। তুলসী রায় ছিলেন সেসব শ্রূতি নাটকে, এইসব নাটক রবীন্দ্রসদন, মহাজাতি সদন, নিরঞ্জন সদন-সহ বিভিন্ন জায়গায় হত। একদিন নাটক শেষে বললেন, আপনি আজ তেমন হাসাতে পারেননি! রাগান্বিত হয়ে বলে ফেললাম– আজকে আমি হাসাতে আসিনি। কাঁদাতেই চেয়েছি। মোহিত লাল মজুমদারের কবিতা বলতে ইচ্ছে করছে, যত ব্যথা পাই তত গান গাই– গাঁথি যে সুরের মালা! ওগো সুন্দর! নয়নে আমার নীল কাজলের জ্বালা! এই লাইনের মতো সবাই আমাকে বলে বসল– তুমি বাংলা সাহিত্যের চার্লি চ্যাপলিন।

অরুণাভ: আপনি প্রথম জীবনে সন্ন্যাসী হতে চাইলেও জীবন আপনাকে করে তুলল বাংলা সাহিত্যের চার্লি চ্যাপলিন! এখন প্রতিদিনই আপনাকে বিভিন্ন সাহিত্যের অনুষ্ঠানে যেতে হয়। এ ছাড়া কলেজ স্ট্রিটের কাছে ঝামাপুকুর লেনে রামকৃষ্ণ সংঘে আপনি নিয়মিত পড়াতে যান। সেই যাপনের কথা কিছু বলুন…
সঞ্জীব: আমি কখনওই ইচ্ছে করে কোনও অনুষ্ঠানে যেতাম না। জোর করে অনেকে নিয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে আমার জীবনে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য উদ্বোধন পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক স্বামী অব্জজানন্দ বলেন সাহিত্যিকদের লেখায় ঠাকুরের কথা লিখে সাধারণ মানুষদের আকৃষ্ট করতে হবে। তারপর দীর্ঘ ষোল বছর সেই পত্রিকাতে ‘পরমপদকমলে’ বিভাগে লিখেছি ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা। যা দিয়ে আমার সারা জীবন ধরে রামকৃষ্ণকে নিয়ে লেখা। পরে বই হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। শুনেছি সেই বই বেস্টসেলার হয়েছে। আমি সেই বইয়ে রামকৃষ্ণের কথা লিখেছি। তাঁর মুখ দিয়েই তাঁকে কথা বলিয়েছি। যেমন ‘শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন’ বইয়েও করেছি। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছি আপনি যেসব বলে গিয়েছেন, এখন জীবন পাল্টেছে; আমরা এখন কী করব? আপনি বলে দিন। আমি ঠাকুরকে মহাঅবতার না করে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি। আর আমার এই আঙ্গিকই শ্রোতাদের মাঝে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

]]>