সৌরভ সেন: ১৯৭১। আমার কিশোরবেলা। তখন এ-বাংলায় রাজনৈতিক কারণে হানাহানি ও অস্থিরতা আমাদের দ্রুত ‘বড়’ করে তুলছে। কাগজে রাজনৈতিক খবর পড়ায় বেশ আগ্রহ। আগের বছর, মানে ১৯৭০-এ স্কুলে হাফ-ইয়ারলি, অ্যানুয়েল কোনও পরীক্ষাই হতে পারেনি। সরাসরি পরের ক্লাসে। ‘মন্থর বিকেলে শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি’র মতন সোডার বোতল ছোড়াছুড়িও সহজ, ছন্দোময় হয়ে উঠেছে। চোখের সামনে পেটো পড়া-ও তখন দৃষ্টি বা শ্রুতিতে গ্রাহ্য। এধার-ওধার থেকে খুনের খবর আসে। পাড়ায়-পাড়ায় সিআরপি-র রুট মার্চ কিংবা কুম্বিং অপারেশনে বাড়িতে ঢুকে মাঝরাতে পুলিশের খানাতল্লাশি তখন নগরজীবনের অঙ্গ।
এহেন সময়ে স্বাধীন বাংলা-র হিল্লোল! পাক-বাহিনীর বর্বরতার ছবি কাগজে-কাগজে, হত্যালীলার বিবরণ। গুলিতে হত্যা, বেয়োনেটে খুঁচিয়ে হত্যা— কত যে প্রকার! ইয়াহিয়া খান একটা আস্ত জল্লাদ, এমন একটা ছবি মনে আঁকা হয়ে গেছে। অনেক পরে শিল্পী কামরুল হাসান-চিত্রিত জল্লাদের (জানোয়ার) ছবিটি দেখে অবাক হই। মনে-আঁকা ছবির সঙ্গে প্রায় মিলে যাচ্ছে! লক্ষ-লক্ষ শরণার্থীর স্রোত। প্লাস্টিক ছাউনিতে, কংক্রিটের পাইপে তাদের আস্তানা। ধু-ধু সল্ট লেক তখন সবে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সেখানেও ৭২ ইঞ্চি পাইপের মধ্যে বসতি। ইতিমধ্যে লোকসভা ভোটে জিতে ইন্দিরা গান্ধী নিজের প্রধানমন্ত্রিত্ব আরও পোক্ত করে নিয়েছেন। দেশে-দেশে তাঁর দৌত্য, ছুটোছুটি কাগজে পড়ছি। নিক্সন, কিসিঞ্জার— এসব নাম শুনলে গা রি-রি করে। অন্য দিকে মনে পড়ছে— সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে ঘুরলেন। কাগজে প্রথম পাতায় বিবরণ। শরণার্থীদের ত্রাণের জন্য বিপুল খরচের বোঝা ভারত সরকারের কাঁধে। খবরের কাগজ, সিনেমার টিকিট— এসবের ওপর অতিরিক্ত মাশুল চাপল। চিঠিপত্রে ডাকমাশুল বাড়ল ৫ পয়সা। একটি অতিরিক্ত স্ট্যাম্প সাঁটতে হত। প্রথম-প্রথম ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের ডাকটিকিটে ‘রিফিউজি রিলিফ’ ছাপ মারা হত, পরে নতুন টিকিট ছাপা হল।
মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি চলেছিল আরেক যুদ্ধ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের— যাকে অনেক পরে গোটা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘ওআরএস’ বা ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন। তখন সীমান্ত-অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরগুলোয় কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাপক ভাবে। এপারের ডা. দিলীপ মহলানবিশ, ওপারের ডা. রফিকুল ইসলাম ওআরএস-এর সফল প্রয়োগ শুরু করলেন। এছাড়াও, নলজাতকের স্রষ্টারূপে চিরস্মরণীয় ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায় শরণার্থীদের অপুষ্টি-রোধে বানিয়েছেলেন ‘ফিশ প্রোটিন কনসেনট্রেট’।
মুক্তিযুদ্ধের খবর আসছে। ছবিও ছাপা হচ্ছে। ‘রাজাকার’, ‘আল বদর’ নামগুলো জানতে শুরু করেছি। এপারের অনেক সাংবাদিক ওপারে গিয়ে জীবন্ত বিবরণ আনছেন। কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে অন্তর্বর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়ে গেছে, মুজিবনগরে। টিভি তো তখন আসেনি। আকাশবাণী কিন্তু এক অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল! নিয়াজি-র আত্মসমর্পণের ছবিতে প্রথম সারিতে দিল্লির সংবাদপাঠক সুরজিৎ সেন! কানে শুনতে পাচ্ছি সেই মন্দ্র কণ্ঠ— “দিস ইজ অল ইন্ডিয়া রেডিও, নিউজ রেড বাই সুরজিৎ সেন…”। কলকাতা কেন্দ্রের প্রণবেশ সেন, উপেন তরফদার, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা স্মরণে থেকে গেছে। ‘সংবাদ-বিচিত্রা’য় গ্রাউন্ড লেভেলের সরাসরি রিপোর্ট। রেডিও-য় শুনে-শুনে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল শেখ মুজিবের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা— “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…”। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। কলকাতারই এক ঘাঁটি থেকে চলত সম্প্রচার। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ অধিবেশন শুরু হত, যদ্দূর মনে পড়ছে। ও-বাংলার সময়ানুযায়ী বেলা একটা নিশ্চয়ই। শুরুতেই বাজানো হত গান : “জয় বাংলা, বাংলার জয়…”।
তারপর তো ডিসেম্বরের তিন তারিখে পাকিস্তানের বোমাবর্ষণ, ভারতের যুদ্ধঘোষণা। পুব ও পশ্চিম রণাঙ্গন। মার্কিন সপ্তম নৌবহর আসছে! কী হয়, কী হয়! রসিকজনের রটনা কিনা জানা নেই, তবে ছড়িয়ে গেল— আমাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবনবাবু নাকি অক্লেশে বলেছেন : আমাদেরও আই এনএস বিক্রান্ত্ আছে! বিক্রান্ত্ ছিল তখন ভারতের একমাত্র এয়ারক্র্যাফ্ট ক্যারিয়ার। তবে সপ্তম নৌবহরের কাছে নস্যি! যা হোক, বিক্রান্ত্ কিন্তু খুলনা থেকে চট্টগ্রাম অবধি নাগাড়ে পাহারা দিয়ে গেছে। সেই বিক্রান্ত্-কে বছর-আষ্টেক আগে লোহার দরে বেচে দেওয়া হল। দু’ ফোঁটা চোখের জল কেউ ফেলেছিল কি?
যুদ্ধ চলছে। ফেনি, আখাউড়া, ঝিনাইদহ, হিলি, বয়রা, ঝিকরগাছা ইত্যাদি নামগুলো ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিচ্ছি। পালাতে গিয়ে পাক-সেনারা সেতু, রেলপথ, ভবন সব নষ্ট করে দিচ্ছে। পদ্মার ওপরে সুবিখ্যাত সারা (হার্ডিঞ্জ) ব্রিজের একটা গার্ডার ধ্বংস করা হল। বয়োজ্যেষ্ঠরা হায়-হায় করে উঠলেন। কলকাতায় ব্ল্যাক-আউট চলছে। সন্ধের পর বাইরে কুপকুপে অন্ধকার। ঘরের মধ্যে আলো না-ঠিকরানো বিশেষ ল্যাম্পশেড। একচিলতে আলোও বাইরে গেলে পুলিশে সতর্ক করে যায়। আকাশে প্লেনের আওয়াজে হামলার আশঙ্কা। টালা ট্যাঙ্ক, হাওড়া ও বালী ব্রিজ নাকি ‘দুশমনে’র পয়লা নিশানা!
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়। যুদ্ধ শেষ। জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সারা দেশে উচ্ছ্বাস। এ-বাংলায় অন্য এক উন্মাদনা। দেয়ালে-দেয়ালে লিখন। দু’ দেশের জাতীয় পতাকার ছবি। তবে তখন কিন্তু বাংলাদেশের পতাকা আঁকা ছিল বেশ ঝঞ্ঝাটের! কারণ মধ্যিখানে ছিল সে-দেশের মানচিত্র। সেটি নিখুঁত আঁকা বেশ কষ্টসাধ্য। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামের আগে জুড়ে গেল বিশেষণ ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’, যা এ-বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরবর্তী কয়েক বছর ব্যবহৃত হয়েছে।
’৪৭-এ ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ভাষার জোর এতটাই যে ধর্মকে পরাভূত করে সেই রাষ্ট্রের জঠর থেকে নতুন এক রাষ্ট্র জন্ম নিল দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক অনন্য নজির।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় এ-বাংলার শিল্পসাহিত্যেও দাগ রেখে গেছে। গান, কবিতা ও অন্যান্য সৃষ্টিতে মাতোয়ারা হয়েছিল মানুষ। আজ ইচ্ছে করলে সেসবের আস্বাদ নেওয়া যায়। বৈদ্যুতিন তথ্যভাণ্ডার এখন অতি সমৃদ্ধ। শুধু একটি গানের হদিশ পেতে ব্যর্থ হয়েছি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ‘পারাপার’ :
আমরা যেন বাংলা দেশের/ চোখের দুটি তারা।/ মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে—/ থাকুক গে পাহারা।/ দুয়োরে খিল/ টান দিয়ে তাই/ খুলে দিলাম জানলা।/ ওপারে যে বাংলাদেশ/ এপারেও সেই বাংলা।।
<
p style=”text-align: justify;”>পঞ্চাশ বছর আগে এটি গান হিসেবে গাওয়া হত। সুরারোপ কার জানা নেই। আমি নিজে অনুপ ঘোষাল-কে অনুষ্ঠানে গাইতে শুনেছিলাম। ছোট্ট গান, জমজমাট সুর, এখনও দিব্যি মনে আছে। তবে কোনও মাধ্যমেই আর শুনি না, খোঁজ পাই না। পুনরুদ্ধার করা যায় কি?