প্রণব ভট্টাচার্য (ইতিহাস গবেষক, পশ্চিমবঙ্গ): প্রথমত আমি বাংলাদেশকে (Bangladesh) আলাদা দেশ বলে ভাবতে পারিনা। আমার বাঙালি সত্তা কোথাও যেন আপত্তি জানায়। আমি ভারতীয় বাঙালি না বাঙালি ভারতীয় আজও বুঝে উঠতে পারিনি। আমাকে ভারতীয় মহা জাতি সত্তার মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে হবে। আমার আলাদা আইডেন্টিটি থাকবে না!
বাঙালি হিসাবে গর্ব অনুভব করি যাঁদের জন্য তাঁরা তো প্রায় সবাই ওপারের-ই। কত নাম আর বলব। অতীশ শ্রীজ্ঞান দীপঙ্কর থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত। বিজ্ঞানীকুলের সব আচার্য্যরা। রত্ন প্রসবিনী আমার সেই ‘বৃহৎ অবিভক্ত বঙ্গ’।
‘ হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন।’ ‘ বঙ্গ আমার ; জননী আমার ; ধাত্রী আমার ; আমার দেশ।’
কলঙ্ক কাঁটাতারের বেড়া। বাঙালির পরাজয়। বাঙালি সত্তার পরাজয়। ধূর্ত ইংরেজ বাঙালিকে হীনবল করার চক্রান্ত করেছে ধীরস্থির ভাবে। দীর্ঘদিন যাবৎ। সহায়তা করেছে এদেশের নানা শক্তি।
একবার মাত্র গেছি বাংলাদেশে। বেনাপোল সীমান্তের ওপারে পা দিয়েই এক আলাদা অনুভূতি। প্রণাম যশোর। কপোতাক্ষ তীরে যে আমার মধুকবি। “জলঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার করুন ডাঙায়” হেঁটে চলেছেন আমার জীবনানন্দ।
বিপুলা পদ্মা পার হয়ে ভায়া ঢাকা কুমিল্লা পর্যন্ত। আমার সৌভাগ্য আমি রাত্রে গিয়েও দাঁড়িয়েছি ” আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ” ভাষা শহীদ স্তম্ভের সামনে। নুয়ে আসে মাথা। একটা জাত জেগে উঠেছিল ভাষা কে কেন্দ্র করে। ভাষা আন্দোলন পরিণতি পেয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। এই প্রাপ্তির জন্য একটা জাতকে মুখোমুখি হতে হয়েছে নারকীয় গণহত্যার। অসম লড়াইয়ে হারাতে হয়েছে লক্ষ তাজা প্রাণ। লুঠ হয়েছে হাজারো মা বোনের ইজ্জত। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনার সাথে লড়াইয়ে হার মানতে বাধ্য হয়েছে বর্বর পাক বাহিনী। সমর্থন করেছি প্রাণমন দিয়ে সেই উজ্জ্বল ভূমিকাকে। ইন্দিরাজীর সাহসী নেতৃত্বকে।
আমি ক্ষমা করতে পারিনা চিন বা আমেরিকার সেদিনের ভূমিকা। আবার ভুলতে পারিনা ভারতের স্বাভাবিক মিত্র সোভিয়েতের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতার কথা।
আজ বাংলাদেশের ৫০ বর্ষ পূর্তিতে স্মরণ করি সেদেশের জাতির নেতা মুজিবুর রহমানকে। আবার মাথায় রাখতে হয় তাঁকেও প্রাণ দিতে হয়েছে বিশ্বাসঘাতক বাঙালির হাতেই।
আজও সক্রিয় অত্যন্ত বিপজ্জনক সেই মৌলবাদী শক্তি। যারা সেদিন ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। আজও করছে। তবুও বাংলাদেশ বেগম হাসিনার নেতৃত্বে অনেক এগিয়েছে। আরও উন্নতির পথে বাংলাদেশ।
ঢাকার আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাসের সেই স্মৃতি- এখানে এসে ইলিশ খাওয়া হয়নি শুনে এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাওয়াত দিলেন। ” আবার আসেন ভাই। আমার বাসায় ওঠেন ঢাকায়। পদ্মার ইলিশ খাওয়াব “। কি আন্তরিকতা! আহা। এইই বাঙালি।
ঢাকার আলোঝলমলে রাস্তায় বাংলায় সাইনবোর্ড দেখে বা ওষুধের স্ট্রিপে বাংলায় ওষুধের নাম দেখে আমার হৃদয় যে উদ্বেলিত হয়। “আ মরি বাংলা ভাষা ; মোদের গরব ; মোদের আশা”। এই ভাষাই তাকে বেঁধে রাখবে অচ্ছেদ্য বন্ধনে। কাঁটাতারের বেড়া আটকাতে পারবেনা তার ব্যাকুল হৃদয়।
বাঙালি এক আলাদা জাতিসত্তা। সে স্বতন্ত্র। তার জাতীয়তা উদার। সে বিশ্বপথিক। আন্তর্জাতিকতা তার রক্তে।