নিউজ ডেস্ক: তালিবান ক্ষমতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মোড়৷ দেশের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ দেশের সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে নিজেকে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছেন।
আরও পড়ুন নিজেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ
২০ বছর ধরে ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তালিবানরা আবারও আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে। কিন্তু, আফগানিস্তানে ক্ষমতা পরিবর্তনের এই সংকটের মধ্যে দেশের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ একটি বড় ঘোষণা করেছেন৷ সালেহ নিজেকে আফগানিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, আমি দেশের সব নেতাদের সহযোগিতা ও সমর্থনের জন্য যোগাযোগ করছি।
কে এই আমরুল্লাহ সালেহ ?
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী তাজিকদের নেতা হলেন আমরুল্লাহ সালেহ। গত মঙ্গলবার তিনি টুইট করে হুঁশিয়ারি দেন, ঘানির অনুপস্থিতিতে তিনিই দেশের ‘কেয়ারটেকার প্রেসিডেন্ট’। ঘানির ডেপুটি হলেও শরীরে তাজিক রক্ত বইছে তাঁর। ফলে এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি নন সালেহ। জনসমক্ষে জানিয়ে দিয়েছেন, ঘানির মতো তিনি পালিয়ে যাবেন না।
আমেরিকার অনেক আগেই পাকিস্তানে লাদেনের ডেরার হদিশ পেয়েছিলেন তিনি। একবার কিংবা দু’বার নয়, মৃত্যুকে হারিয়ে ফিরে এসেছেন বার বার। তাই বাকিরা যখন গা ঢাকা দিয়েছেন, বন্দুকের নলের সামনে এগিয়ে এসেছেন আমরুল্লাহ সালেহ। নিজেই নিজেকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, তালিবানের সামনে মাথা নোয়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। শৈশবেই অনাথ হয়ে যাওয়া থেকে দেশের অন্যতম সাহসী গুপ্তচর, পরবর্তী কালে দুঁদে রাজনীতিক, বছর ৪৮-এর আমরুল্লাহর জীবন হার মানায় রোমাঞ্চকর সিনেমাকেও।
Clarity: As per d constitution of Afg, in absence, escape, resignation or death of the President the FVP becomes the caretaker President. I am currently inside my country & am the legitimate care taker President. Am reaching out to all leaders to secure their support & consensus.
— Amrullah Saleh (@AmrullahSaleh2) August 17, 2021
১৯৭২ সালে পঞ্জসিরে তাজিক পরিবারে জন্ম আমরুল্লার। শৈশবেই মা-বাবাকে হারান। তার পর থেকে একমাত্র বোনকে নিয়ে শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে ১২ বছর বয়সেই মুজাহিদিনে যোগ দেন। তৎকালীন মুজাহিদিন কম্যান্ডার আহমদ শাহ মাসুদের কাছে পাকিস্তানে অস্ত্র শিক্ষাও নেন। অল্প কয়েকদিনেই মাসুদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আমরুল্লাহ। আমরুল্লাহকে না পেয়ে ১৯৯৬ সালে তাঁর বোনকে নৃশংস অত্যাচারের পর খুন করে তালিবানরা।
পরবর্তী কালে একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় আমরুল্লাহ লেখেন, ওই ঘটনার পর তালিবানদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই পাল্টে যায়। প্রাণ চলে গেলেও কখনও তালিবানদের সঙ্গে এক ছাদের নীচে দাঁড়াবেন না তিনি। মুজাহিদিনে থাকাকালীন মাসুদ এবং ভারতের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। তালিবানদের রুখতে ভারত থেকে আফগানিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র যেত তাঁর তদারকিতেই। মাসুদের তালিবান বিরোধী নর্দার্ন অ্যালায়্যান্সের সদস্যও ছিলেন আমরুল্লাহ। ২০০১ সালের মাসুদকে হত্যা করে তালিবানরা। তার দু’দিন পরেই আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা চালায় আল কায়দা।
আরও পড়ুন আত্মসমর্পণের প্রশ্ন উড়িয়ে আমেরিকার কাছে অস্ত্রসাহায্য চাইলেন নিহত তালিবান-বিরোধী নেতার ছেলে
ঠিক তার পরেই আফগানিস্তানে ন্যাটো পাঠায় আমেরিকা। আমরুল্লাহকে দেশের গুপ্তচর সংস্থা ন্যাশনাল ডিরেক্টরেট অব সিকিয়োরিটির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। ৯/১১ হামলাকারী আল কায়দা এবং তাদের প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ছিল তালিবানের বিরুদ্ধে। ফলে সেই সময় তালিবান-বিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত আমরুল্লাহকে লুফে নেয় আমেরিকা। তাঁর তদারকিতেই পাকিস্তান সীমান্তে ঢুকে বহু জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করেন আফগান গুপ্তচররা।
২০০৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে আমরুল্লা দাবি করেন, পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ সংলগ্ন এলাকায় লুকিয়ে রয়েছেন ওসামা বিন লাদেন। ইসলামাবাদ তাঁকে আশ্রয় দেওয়ায় মাসুল গুনতে হচ্ছে আফগানিস্তানকে। আমরুল্লাহর এই দাবিতে তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুসারফ রেগেমেগে বৈঠক বাতিল করে দেন। পাঁচ বছর পর, ২০১১ সালে সেও অ্যাবোটাবাদেই পাক সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অদূরেই লাদেনের হদিশ মেলে। তার আগেই অবশ্য, ২০১০ সালে কারজাই সরকার থেকে বেরিয়ে যান আমরুল্লাহ। কারজাই তালিবানের প্রতি নরম মনোভাব দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। কারজাইয়ের সঙ্গ ছেড়ে বসেজ-ই-মিল্লি নামে আলাদা দলও গড়েন তিনি। ২০১৭ সালে নিজের দলের সদস্যদের নিয়ে আশরফ ঘানির সরকারে যোগ দেন। একবছর পর, ২০১৮ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী হন। ২০২০ সালে দেশের উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
১৪ আগস্ট তালিবানরা আফগানিস্তান দখল করায় দেশ ছাড়েন প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানি। শোনা গিয়েছিল, দেশ ছেড়েছেন আমরুল্লাহও। কিন্তু তিনি টুইট করে জানিয়ে দেন, আফগানিস্তানেই রয়েছেন। তালিবানদের সামনে মাথা নোয়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। শুধু তাই নয়, তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি সঞ্চয় করছেন। তাঁর ‘গুরু’ মাসুদের ছেলে আহমদ মাসুদ এবং গনি সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বিসমিল্লা খান মহম্মদির সঙ্গে মিলে পঞ্জসিরে তালিবানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতে তিনিই নেতৃত্ব দেন।
এখনও পঞ্জশির দখল করতে পারেনি তালিবানরা। উলটে তাঁর মদতেই আহমেদ মাসুদ তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার জন্য আমেরিকার কাছে অস্ত্রসাহায্য চেয়েছেন বলেও মনে করছেন অনেকে।