প্রসেনজিৎ চৌধুরী: বাঁশি বাজল। শুরু হয়ে গেল বল নিয়ে গোল করার খেলা। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নেই। গ্যালারি থেকে চিৎকার জয় হিন্দ-জয় বাংলা। কে কোন দলের সমর্থক বোঝার উপায় নেই।
পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধ চলছিল পূর্ব পাকিস্তানের মাঠে ঘাটে।এই রক্তাক্ত অধ্যায়ের এক পর্বে ফুটবলের বাঁশি বেজেছিল। বাঙালির রক্তে মিশে থাকা খেলা।
ফিফা মানেনি, মেনেছে কোটি কোটি হৃদয়…
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই। ফুটবল ইতিহাসে এক স্বর্ণালী দিন। বিশ্বে প্রথম এমন ম্যাচ যাতে সরাসরি গেরিলা যোদ্বারা খেলেছিলেন। ফিফা স্বীকৃত না হলেও এই ফুটবল ম্যাচ হয়েছে গবেষণার বিষয়। একটি দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে জড়িয়ে আছে বল দখলের খেলা।
সেদিন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম। নদিয়া জেলা প্রশাসন কর্তাদের ঘুম উড়ে গেছে। যে সে ব্যাপার নাকি! এতজন গেরিলা যোদ্ধা খেলতে নেমেছে। আজ খেলবে, কাল যুদ্ধে নামবে! কাল কী হবে কেউ জানে না।
খেলা চলছে। নদিয়া জেলা দল বনাম ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’-এর, যেটি বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়া। আর নদিয়ার দল একপ্রকার ভারতীয় একাদশের ভূমিকা নিয়েছে। ‘মুক্তি’ লোকেরা কেমন? যাদের কথা রোজ কাগজে আসছে, আকাশবাণীর সংবাদে বলছে, তাদের দেখতেই দর্শকদের বেশি আগ্রহ। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামের দর্শকরা প্রবল উত্তেজিত।
গেরিলা ফুটবল দলটির সবাই পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন। তাদের সমর্থকরাও সীমান্তের ওপারে মুক্তাঞ্চল দিয়ে নদিয়া ঢুকেছেন। প্রবল আক্রমণাত্মক ম্যাচটি ২-২ গোলে অমীমাংসিত হয়েছিল। ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ের ইতিহাসে এই ম্যাচটিরও সুবর্ণ জয়ন্তী।
প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ রচিত দুই জাতীয় সঙ্গীত
সেদিন খেলার আগে কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে একইসঙ্গে বেজেছিল দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত। তথ্য পরম্পরা মিলিয়ে নিলে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই বিশ্বে প্রথমবার রবীন্দ্রনাথের লেখা দুটি জাতীয় সঙ্গীত বেজেছিল কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ সরকারিভাবে তখনও স্বীকৃত নয়। তবে কলকাতায় থাকা প্রবাসী মুজিবনগর সরকার (অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার) আগেই রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা…’কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয়।
চাকরি গেল ভারতীয় আমলার!
বিতর্ক মিশে আছে এই ম্যাচে। তখনও আন্তর্জাতিকভাবে অস্বীকৃত বাংলাদেশ। সেই দেশের পতাকা ওড়ানোর দায়ে নদিয়ার তৎকালীন জেলা কর্তা (ডিসি) দীপককানত্ম ঘোষকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তিনি কূটনৈতিক প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করেছিলেন।৩
<
p style=”text-align: justify;”>৩৪ জন খেলোয়াড়, ম্যানেজার এবং কোচ সহ মোট ৩৬ জন নিয়ে গড়া ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল’ দলের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। সহ অধিনায়ক ছিলেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। কোচ ছিলেন ননী বসাক।গেরিলা বাহিনীর ফুটবল দল পরপর ১৬টি ম্যাচ খেলেছিল ভারতে। কলকাতায় সৌজন্য ম্যাচে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে (গোষ্ঠপাল একাদশ) ও মুম্বইতে (তখন বম্বে) মহারাষ্ট্র দলের বিরুদ্ধে খেলে। মোট ১২টি ম্যাচে জয়ী হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। প্রায় ৫ লক্ষ টাকা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগ্রহ করে।