প্রসেনজিৎ চৌধুরী: একটা স্কুলের ঘর। চারদিকে পাহারা দিচ্ছে যারা তাদের কাছে বোমা ও ছুরি আছে। এলাকাটা নকশালপন্থীদের হামলায় ব্যাতিব্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে জ্যোতি বসুর নিরাপত্তা দিয়েছিল তাঁর দল সিপিআইএম। তিনি এলেন। বৈঠক শুরু হল। আর ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের (Bangladesh 50) সময়ে এই মুহূর্তের কথা তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ প্রাক্তন মন্ত্রী ও ওর্য়ার্কাস পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন।
সেদিনের বৈঠকে পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বামমনস্ক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংগঠন তৈরি হয়েছিল। ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ এই সংগঠনটির কথা সত্তরের দশকে সংবাদপত্রগুলিতে আলোচিত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রায় বিস্মৃতির আড়ালেই চলে গিয়েছে। গোপনে এই সংগঠন ১৯৭১ সালে সীমান্তের ওপারে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পথ নেয়। যদিও কূটনৈতিক পন্থা অনুসরণ করে বিষয়টি নিয়ে নীরবই ছিলেন জ্যোতি বসু। পশ্চিমবঙ্গের বাম নেতৃত্ব বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে তেমন আলোচনা চালাননি।
৫০ বছর আগের বেলেঘাটার রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি ছিল। একাত্তরের কলকাতা যেমন উত্তপ্ত। তেমনই গরম পশ্চিমবঙ্গ। নকশালপন্থী, সিপিআইএম ও কংগ্রেসের যুব বাহিনীর মধ্যে এলাকা দখলের সশস্ত্র ঘাত প্রতিঘাত মুহূর্ত দেখেছেন রাজ্যবাসী। একই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে চলছিল বাংলাদেশি গেরিলাদের মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন কিংবদন্তি দুই মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আকবর খান রনো ও রাশেদ খান মেনন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন দেশটির কমিউনিস্ট নেতা হায়দার আকবর খান রনো। বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধার কলমে ধরা রয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতিবাবুর কিছু অজানা দিক।২০১০ সালে কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর প্রয়াণ হয়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে হায়দার আকবর খান রনো একটি প্রবন্ধ লেখেন। ‘ইতিহাসের মহানায়ক কমরেড জ্যোতি বসু’ শিরোনামে প্রবন্ধটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্লগ ও বাংলাদেশের সংবাদপত্র, গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় সেই বছরেই।
সেই প্রবন্ধে হায়দার আকবর খান রনো লিখেছেন, ‘জ্যোতি বসু সর্ম্পকে কিছু লিখতে হলে অবশ্যই ১৯৭১ সালে তাঁর এবং তাঁর পার্টির ভূমিকার কথা স্মরণ করতেই হবে। সেই সময় ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটার এক স্কুলে কয়েকটি বামসংগঠন এক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করেছিল “ বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি।” এই সংগঠনটি বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে মেনে নিয়েই দেশের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্রভাবে যুদ্ধ করেছিল (ছোট বড় ১৪টি সশস্ত্র গেরিলা ঘাঁটি যাদের ছিল) এবং ভারতে অবস্থিত মুক্তিফৌজের ভেতরে থেকেও যুদ্ধ করেছিল। সিপিআই (এম) তাদের সংগৃহীত অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল। প্রধানত সাহায্য করেছিল বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের। তখন বামপন্থীদের বিশেষ করে যারা চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন, তাদের ভারতে চলাফেরা বেশ অসুবিধাজনক ছিল। এক্ষেত্রে সিপিআই (এম) এবং তার নেতা জ্যোতি বসু বাংলাদেশের বামকর্মীদের নিরাপত্তা প্রদান ও অন্যান্য সহয়তা প্রদান করেছিলেন।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট নেতা রনো লিখেছেন- “প্রসঙ্গক্রমে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে একবার আমাকে ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার লোক আগরতলা থেকে ধরে নিয়ে শিলং এ নিয়ে যান। সেখানে ভারতের সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল সুব্রাহ্মনিয়াম আমাকে দুদিন ইন্টারোগেট করে পরে সসম্মানেই প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। ঘটনাটি আমাকে বেশ বিচলিত করেছিল। কারণ কোন ধরনের গোয়েন্দা সংস্থার সংস্পর্শ আমার পছন্দীয় নয়।
কোলকাতায় এসে বিষয়টি কমরেড প্রমোদ দাসগুপ্ত ও কমরেড জ্যোতি বসুর কাছে বিবৃত করলাম। আমার মানসিক অবস্থা থেকে জ্যোতি বসু একটু হেসে…সুলভ ভঙ্গিতে বললেন “বিপ্লব করতে হলে তো কত রকম সংস্পর্শে আসতে হবে। এতে ঘাবড়ানোর কি আছে।” তিনি বলেছিলেন যে, “আমরা বাংলাদেশের বামপন্থীদের একমাত্র অস্ত্র দেয়া ছাড়া সবরকম সাহায্য করবো। কারণ অস্ত্রের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের।” অবশ্য একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, জ্যোতি বসু সংকীর্ণতাবাদী ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথমে চাইতেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হোক। একই সঙ্গে অবশ্যই তিনি কামনা করতেন সঠিক লাইন গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা সামনে আসুক। এটাই তো স্বাভাবিক।”
<
p style=”text-align: justify;”>১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ছিল রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ রাজ্য। ১৯৭৭ সালে সরকার পরিবর্তন হয়। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছিল। টানা ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গঙ্গা জলবন্টন চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। বাংলাদেশেই জ্যোতি বসুর পৈত্রিক বাসস্থান। সেটি এখন সেদেশের জাতীয় সম্পত্তি ও কিংবদন্তি নেতার নামে গ্রন্থাগার।