ডিজিটাল ডেস্ক: সারা বিশ্বের নজর এখন করোনাভাইরাসের নানা মিউটেশনের দিকে৷ কোভিডের নতুন নতুন ধরন দ্রুত ছড়াচ্ছে৷ একই সঙ্গে বেশি সংখ্যায় লোক এখন সংক্রমিত হচ্ছে৷ ভ্যাকসিনকে ঠেকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও এসব ভ্যারিয়েন্টের বেশি।
মিউটেশন কেন ঘটে?
বেঁচে থাকা এবং বংশবৃদ্ধির জন্য সব ভাইরাসের দেহেই পরিবর্তন ঘটে। বেশিরভাগ সময়েই এসব পরিবর্তন খুবই সূক্ষ্ম। কোন কোন সময়ে এতে ভাইরাসেরই ক্ষতি হয়। তবে অন্যগুলোতে যখন বড় ধরনের মিউটেশন ঘটে তখন রোগটা আরও বেশি সংক্রামক রূপ নেয় এবং রোগীর ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়৷ সংক্রমণ কিংবা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে যখন মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়৷ ভাইরাস তখন মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেকে পরিবর্তন করে সেই প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে ফেলে। কোন ভাইরাস কতখানি বিপজ্জনক, তা জানতে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের জেনেটিক কোড, পরীক্ষাগারে তার আচরণ এবং মানুষের মধ্যে সংক্রমণের দিকটি লক্ষ্য করেন।
নানান ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে কী জানি?
সমগ্র বিশ্বে করোনাভাইরাসের হাজার হাজার ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ইউকে, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টকে ”উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট” বলে মনে করা হয়। ইউকে বা কেন্ট ভ্যারিয়েন্ট (যার আরেক নাম B.1.1.7) প্রথম দেখা গিয়েছে ব্রিটেনে। পরে ৫০টিরও বেশি দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। এটি এখনও মিউটেট করছে। ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট (P.1) ছড়িয়ে পড়েছে শতাধিক দেশে। এর মধ্যে ব্রিটেনও রয়েছে৷ এছাড়াও ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ব্রিটেনে ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্টের (B.1.617 ) দুই শতাধিক কেস ধরা পড়েছে। তবে ভারতে কোভিড-১৯ মহামারির বর্তমান ঢেউয়ের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
নতুন ভ্যারিয়েন্ট কি সত্যিই বেশি বিপজ্জনক?
যারা এসব ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগের অসুস্থতার মাত্রা অনেক বেশি এমন কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। করোনার মূল রূপের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা গিয়েছে, বয়স্ক এবং শারীরিক সমস্যা যাদের প্রকট এসব ভ্যারিয়েন্টেও তারাই বেশি ঝুঁকির মুখে। কিন্তু ভ্যাকসিন নেওয়া হয়নি এমন জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি সংক্রামক কোন ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটবে বেশি। কিছু গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, ইউকে ভ্যারিয়েন্টে ব্যক্তি-বিশেষের ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩০% বেশি। তবে এর পক্ষে প্রমাণ খুব একটা জোরাল নয়। কিন্তু করোনার সব ধরনের স্ট্রেইনের ক্ষেত্রেই ডাক্তারদের উপদেশ একই- ভাল করে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ফেস মাস্ক ব্যবহার করা এবং ঘরের মধ্যে বাতাস চলাচল নিশ্চিত করা।
ইউকে, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল কিংবা ইন্ডিয়ান – সবগুলো ভ্যারিয়েন্টই নিজের দেহের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এটি ভাইরাসের একটি অংশ যেটি দিয়ে সে মানুষের দেহকোষের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। । N501Y নামে পরিচিত একটি মিউটেশনে দেখা গিয়েছে, দেহকোষে সংক্রমণ এবং বিস্তারের ক্ষেত্রে এটি ভাইরাসকে বিশেষ সুবিধে করে দেয়। কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইউকে/কেন্ট ভ্যারিয়েন্টটি ৭০% বেশি সংক্রামক৷ যদিও পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড বলছে, এটি ৩০%-৫০% সংক্রামক। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টেও E484K নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন ঘটেছে। এর ফলে ভাইরাস অ্যান্টিবডির হাত থেকে পালাতে পারে। অ্যান্টিবডি দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইউকে ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে সম্প্রতি এধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্টেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন ঘটেছে৷ যার ফলে এটা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেদ করতে পারে। সেজন্যই বিজ্ঞানীরা এখন এটি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে গবেষণা চালাচ্ছেন।
নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কি কাজ করতে পারবে?
এখন যেসব ভ্যাকসিন চালু রয়েছে, সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল করোনার মূল ধরনটির চিকিৎসার জন্য। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও এগুলো কাজ করবে, তবে তার কার্যকারিতা হবে কম। একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, আগে যাদের কোভিড হয়েছে এবং কিছুটা ইমিউনিটি রয়েছে, ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট সম্ভবত তাদের দেহের অ্যান্টিবডিকে ঠেকিয়ে দিতে পারে। ফাইজারের ভ্যাকসিনের ওপর গবেষণাগারের প্রাথমিক তথ্য এবং রোগীদের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এটি নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করে, তবে কার্যকারিতা কম। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ডেটা থেকে জানা যাচ্ছে, এটি ইউকে/কেন্ট ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও একইভাবে কার্যকর। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এটি কম সুরক্ষা দেয়। কিছু প্রাথমিক ফলাফল থেকে জানা যাচ্ছে, মডার্না ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে এর ইমিউন রেসপন্স দুর্বল এবং স্বল্পস্থায়ী।
নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্য কি বুস্টার টিকা লাগবে?
ভবিষ্যতের করোনা ভ্যারিয়েন্টগুলোর জন্য টিকা তৈরি করতে ব্রিটিশ সরকার কিওরভ্যাক নামে একটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। পাঁচ কোটি ডোজ টিকার আগাম অর্ডারও দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে ভ্যারিয়েন্টগুলোতে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটবে তার ওপর নির্ভর করবে বয়োবৃদ্ধ এবং প্রকট শারীরিক সমস্যার শিকার ব্যক্তিদের চলতি বছরের শেষ নাগাদ এধরনের বুস্টার টিকার প্রয়োজন হবে কিনা।
সবার নজর এখন করোনাভাইরাসের মিউটেশনের দিকে – কোভিড-১৯য়ের নতুন নতুন ধরন যেমন দ্রুত ছড়ায়, তেমনি বেশি সংখ্যায় লোক এখন এগুলোতে সংক্রমিত হচ্ছে, এবং ভ্যাকসিনকে ঠেকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও এসব ভ্যারিয়েন্টের বেশি।