নয় দশক পেরিয়েও ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’ বোরোলিন

বিশেষ প্রতিবদেন: ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের কুখ্যাত বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিনত হয় পূর্ণাঙ্গ স্বদেশী আন্দোলনে। এই স্বদেশী আন্দোলন এশিয়ান পেইন্টস, টাটা স্টিল, ল্যাকমের মতো…

Boroline

বিশেষ প্রতিবদেন: ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের কুখ্যাত বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিনত হয় পূর্ণাঙ্গ স্বদেশী আন্দোলনে। এই স্বদেশী আন্দোলন এশিয়ান পেইন্টস, টাটা স্টিল, ল্যাকমের মতো আরও অনেক আইকনিক ব্র্যান্ডের জন্ম দেয়। এই ব্র্যান্ডগুলি কেবল বিদেশী পণ্য বিক্রয়কেই কমিয়ে করে দেয়নি, ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছিল বাঙালিদেরও। যার রেশ ছিল কয়েক দশক পর্যন্ত।

যদিও অনেক দেশীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি হলেও বহুদিন বাংলায় ছিল না নিজস্ব কোনো ক্রিম তৈরির কোম্পানি। ফলে পুড়ে গেলে বা ক্ষতে লাগাতে হত বিভিন্ন ভেষজ উপাদান। নয়তো ভরসা বিদেশী দামী অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম। ঠিক সেই সময় বাজারে এল বাঙালির নিজের অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, বোরোলিন। সালটা ১৯২৯, জি ডি ফার্মেসির প্রতিষ্ঠাতা গৌরমোহন দত্ত বাঙালিকে উপহার দিলেন তাদের ‘নিজেদের ক্রিম’। কলকাতার আলিপুরে নিজের বাড়িতে শুরু করেন ক্রিমটির উৎপাদন। যা এখন বোরোলিন হাউস নামে পরিচিত।

সেই শুরু, আজ প্রায় ৯০ বছর পরেও বাঙালির ভরসা সেই ‘বোরোলিন’। বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের কথায় বোরোলিন হল ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’। যদিও দেশীয় উপাদানে তৈরি হলেও ক্রিমের নামে কিন্তু রয়েছে বিদেশী ছোঁয়া। বোরোলিন নামটি এসেছে দুটি আলাদা শব্দ থেকে, বরিচ পাউডার থেকে “বোরো” এবং “অলিন” ল্যাটিন শব্দ ওলেমের একটি রূপ অর্থাত্ তেল। বোরোলিনের লোগো ‘হাতি’, যা স্থিরতা এবং শক্তির প্রতীক। বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় বোরোলিন এখনও “হাতিওয়ালা ক্রিম” হিসাবে পরিচিত।

অবশ্য শুধু বাঙালিরাই নন, বোরোলিন ব্যবহার করতেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও, দেশের ক্রিম বলে কথা। যদিও, ব্রিটিশদের রাজত্বে দেশীয় কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, দেশীয় পণ্য তৈরি করা এবং ব্যবসা টিকিয়ে রাখা ছিল যথেষ্ঠ কঠিন। সেই কাজটিই জি ডি ফার্মেসিই করে আসছে বহুদিন ধরে। গৌরমোহন দত্তের এই মানসিকতাই এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। এছাড়াও তিনি ছিলেন কলকাতা ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য। কারণ, তিনি মনে করতেন দেশ স্বাধীন করার জন্য বিপ্লব ছাড়াও স্বাধীন ব্যবসায়ী সংগঠন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। যারা দেশীয় পণ্য তৈরি করবে এবং দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ঘটাবে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার খুশিতে তিনি বিনামূল্যে এক লক্ষ বোরোলিন বিতরন করেন।

বর্তমানে আমরা নানারকমের ক্রিমই ব্যবহার করেই থাকি। পরিবর্তিত ঋতু অনুযায়ী আমাদের শরীরের চাহিদারও পরিবর্তন হয়। যেমন ধরুন বর্ষাকালে তো আমাদের ত্বক শুকিয়ে যায় না, কিন্তু, শীতকালে তা হয়। ত্বক শুকিয়ে যায়, ঠোঁট ফেটে যায়। ফলে নানারকমের ক্রিম ব্যবহার করতে হয় প্রত্যেককেই। কিন্তু তাতেও কদর কমেনি বোরোলিনের। প্রায় সব ঋতুতেই বাঙালির ত্বকের সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান এই ‘সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম’।

বোরোলিনের ব্যবহার এবং বাঙালি –

ক্ষত সাড়াতে: শরীরের কোথাও কেটে গেছে? ইনফেকশনের ভয়? না হয়! বাঙালির তাতেও একটাই ভরসা, বোরোলিন। কেটে যাওয়া জায়গাটা ভালো করে ধুয়ে সেখানে বোরোলিন দিয়ে রাখুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ত পড়া বন্ধ, ভয় নেই ইনফেকশনেরও।

বর্ষাকালের যত্নে: বর্ষাকালে বাইরে বেরোলেই রাস্তার জমা জল, কাদা লেগে ফাংগাল ইনফেকশন হতে পারে। তাই বাড়ি এসে ভালো করে পা ধুয়ে রাতে শোবার সময়ে একটু বোরোলিন মাখলে এই সমস্যা হয় না। এভাবেই প্রতিবার বর্ষা পাড় করছে বাঙালি।

শীতের সুরক্ষায়: শীতকালে আমাদের সবার প্রধান সমস্যা হল ঠোঁট ফাটা। এছাড়াও যেহেতু পা সরাসরি মাটির সংস্পর্শে আসে তাই সেখানে রোজ ধুলো, ময়লা ঢুকে ইনফেকশন হতে পারে, গোড়ালি ফেটে যায়। বাঙালি তাই শীতের শুরু থেকেই বোরোলিন ব্যবহার করতে শুরু করে।

রাতের পরিচর্যায়: বোরোলিন খুব ভালো নাইট ক্রিম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই ক্রিম শুধু ত্বকের শুকিয়ে যাওয়া ভাবটাই কাটায় না, তার সঙ্গে স্কিনকে ভেতর থেকেও মজবুত করে। ত্বকের পি এইচ লেভেল ঠিক রাখে।