প্রসেনজিৎ চৌধুরী: সুভাষবাবু কংগ্রেস ত্যাগ করে যেদিন ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করলেন সেদিনই ইতিহাসের কিছু নির্দেশ লেখা হয়ে ছিল। কংগ্রেসের প্রথম বড় ধাক্কা কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর দলত্যাগ। ভারতীয় রাজনীতির দলত্যাগের এই নজির এখনও সমান জ্বলজ্বলে। সুভাষবাবু বামপন্থী ছিলেন, তাঁর দলের পতাকা, নীতি আদর্শের দিকটি স্পষ্ট। কংগ্রেস তাহলে কী?
কংগ্রেস তখনও বৃহত্তম রাজনৈতিক মঞ্চ, এখনও। জাতীয় কংগ্রেস বকলমে ইন্দিরা কংগ্রেস বহুধা বিভক্ত হয়েছে, জুড়েছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসের গর্ভগৃহ হিসেবে কংগ্রেসকে অস্বীকার করা যাবেনা। তবে কংগ্রেস ঘোষিত দক্ষিণপন্থী দল। আবার এই দলে বাম মনস্কদের সমাহার কম নয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (CPI) ত্যাগ করে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিলেন কানহাইয়া কুমার। কংগ্রেসের আদর্শে এখন তিনি চলবেন। যে কংগ্রেস জওহরলাল নেহরুর মতো সমাজতান্ত্রিক নেতা ছিলেন, সেই কংগ্রেসে সামিল আধুনিক ভারতের সমাজতান্ত্রিক তথা কমিউনিস্ট নেতা কানহাইয়া কুমার। কানহাইয়ার দলত্যাগ ভারতের অন্যতম কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন বিপ্লবী নেতা ভগত সিংয়ের জন্মদিনেই। তবে দলীয় পতাকার রং পাল্টে গেল। সিপিআই জাতীয় পরিষদ, বিহার রাজ্য পরিষদের নেতারা জানতেন কানহাইয়া যাচ্ছেন। বস্তুতপক্ষে সিপিআই কেন্দ্রীয় নেতাদের কিছুই করার ছিলনা। কানহাইয়ার মতো প্রবল জনপ্রিয়, তার্কিক নেতার কাছে দলের বাকি নেতারা তুচ্ছ তা স্পষ্ট হয়েছে মোদী জমানাতেই।
কানহাইয়া কুমারের সিপিআই ত্যাগ ইতিহাসের কয়েকটি দিক ফের দেখতে বাধ্য করছে। জাতীয় কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক ও বাম মনস্ক নেতার অন্যতম নেহরু। বস্তুত নেহরু প্রায় ঘোষিত বাম ঘেঁষা নেতা ছিলেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ। সেই প্রভাবে দেশের শিল্প পরিকাঠামো গড়া, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চলা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
নেহরু পরবর্তী ইন্দিরা জমানায় কংগ্রেসের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত। বাবার পথেই দেশীয় শিল্প, আর্থিক কাঠামোর জাতীয়করণে ইন্দিরা পুরোপুরি সোভিয়েত অনুগামী হন। নেহরু-ইন্দিরার পরিচিত ও বন্ধুবলয়টি আরও লাল তারকা খচিত। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এম এন রায়, কমিউনিস্ট মার্কসবাদী নেতা জ্যোতি বসু, এস এ ডাঙ্গে, মোহন কুমারমঙ্গলম, ভূপেশ গুপ্ত, অজয় ঘোষ, পার্বতী কৃষ্ণান-কে নেই। একেবারে লাল তারার ঘেরাটোপে থেকেও নিজের মতো ছিলেন পিতা-পুত্রী।
১৯৬২ সালে ভারত-চিন সংঘর্ষের পর সিপিআই ভেঙে ১৯৬৪ সালে সিপিআইএম তৈরি হয়। নেহরু পরবর্তী জমানায় ক্ষমতা ধরে রাখতে সিপিআইএমের(CPIM) সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে সরাসরি সংঘর্ষে গেলেও সিপিআইয়ের(CPI) সঙ্গে কংগ্রেসের সংযোগ ছিল নিবিড়। সে কারণেই ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে সমর্থন করে সিপিআই। পরে অবস্থান বদলেছে এই দলটি। জরুরি অবস্থার বিরোধী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ কংগ্রেসের মধ্যে চরম সমাজতান্ত্রিক নেতা ছিলেন। পরে তিনিই দেশের প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার গঠনের রূপকার হন।
জরুরি অবস্থার সময় দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্র বর্তমান সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তিনিও কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ। আর মোদী জমানাকে ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’ বলা জেএনইউ প্রাক্তনী কানহাইয়া কুমার এখন বৃহত্তর মোদী বিরোধী মঞ্চ কংগ্রেসে সামিল। কংগ্রেসের অন্যতম আলোচিত নেতা মনিশংকর আইয়ার তাঁর বাম নীতির জন্য আলোচিত। যতটা আলোচিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁর মার্কসীয় অর্থনীতির জন্য। এরা সবাই কংগ্রেসের ‘বামপক্ষ’।
সেই তালিকায় আরও এক তুখোড় ছাত্র নেতা কানহাইয়া কুমার এলেন। কংগ্রেসের ভাষণ দেওয়া নেতার অভাব মিটল। ক্ষয়িষ্ণু সিপিআই-তে থেকে মোদীর মুখোমুখি হওয়া আর কংগ্রেসে গিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার মধ্যে বিরাট পার্থক্য। যারা ময়দানি রাজনীতি করেন তারা জানেন বড় দলে খেলার সুবিধা। জার্সি বদলে সেই সুবিধা নিলেন কংগ্রেসের কমিউনিস্ট নেতা কানহাইয়া কুমার।