বিশেষ প্রতিবেদন: কলকাতার অন্যতম সেরা বারোয়ারি পুজো মধ্য কলকাতার ‘সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার’। রূপোর প্যান্ডেল, প্রতিমার সোনার শাড়ি কিংবা পুরো দুর্গা মূর্তিই সোনার বানিয়ে দেওয়া, সবেতেই চমক। পুজোর জাঁকজমকের আড়ালে কোথাও যেন হারিয়ে যান নামাঙ্কিত পার্কের স্বাধীনতা সংগ্রামী সন্তোষ কুমার মিত্র। যাঁর জন্ম ১৫অগাস্ট মৃত্যু ১৬ সেপ্টেম্বর আজকের দিনে। তাঁর আত্মবলিদান, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ইংরেজদের দিনের পর দিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো কিছু নিয়েই আলোচনা হয় না । তাঁর বাড়ি ছিল পূজো প্রাঙ্গণ থেকে কিছু দূরে একটি সরু গলিতে। সে বাড়ির অস্ত্বিত্ব তো নেই, অনেকেই জানেন না কে এই সন্তোষ মিত্র।
‘সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার’-এর পুজোর শুরু এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে সামনে রেখেই। তবে ব্র্যান্ড সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার-এ ঢাকা পড়েন বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্র। পার্কের নাম বদলও আবার ইংরেজ শাসনকালেই। ১৯২০, গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। অত্যাচারী ইংরেজকে দেশছাড়া করতে বাংলার প্রত্যেক যুবক তখন প্রায় বদ্ধপরিকর। এমনই এক যুবক ছিলেন সন্তোষ কুমার মিত্র। এই মেধাবী ছাত্র ১৯১৯ সালে বিএ এবং ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সসম্মানে মাস্টার্সে উত্তীর্ণ হন। সঙ্গে ছিল এলএলবি ডিগ্রিও। কিন্তু উজ্জ্বল এবং নিশ্চিত ভবিষ্যতকে এক লহমায় দূরে সরিয়ে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ মাতৃকার সম্মান উদ্ধারের কাজে।
কলেজ পাশ করার পর বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্র কংগ্রেসের হয়ে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এই সূত্রে তিনি হুগলি বিদ্যামন্দিরে যাতায়াত করতেন। হুগলি বিদ্যামন্দিরের প্রধান ছিলেন বিপ্লবী ভূপতি মজুমদার। তাঁর সূত্র ধরেই সন্তোষ মিত্রের পরিচয় বিপ্লবী বারীন্দ্র ঘোষ এবং যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের সঙ্গে। ধীরে ধীরে গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। প্রভাবিত হন সহিংস বৈপ্লবিক মতাদর্শে। ইংরেজদের কুনজরে চলে আসেন সঙ্গে সঙ্গে।
১৯২৩ সালে ‘শাঁখারীটোলা হত্যা মামলায়’ এক ইংরেজ পোস্ট মাস্টারকে খুনের অভিযোগে তাঁর উপরে সব সন্দেহ এসে পড়ে। গ্রেফতারও হন। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যান। বিখ্যাত আলিপুর বোমার মামলাতেও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। প্রমাণ ছিল না, এবারও ছাড়া পেয়ে যান। সন্তোষ কুমার মিত্র প্রকাশ্যে যেভাবে বৈপ্লবিক মতাদর্শ প্রচার করে বেড়াচ্ছিলেন তা ইংরেজদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর উপর প্রয়োগ করা হয় ‘বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ অর্থাৎ তাঁকে দেশের নিরাপত্তার জন্যে বিপদ্জনক ঘোষণা করে দেয় ইংরেজ সরকার। এই আইন অনুযায়ী বিনা বিচারে তাঁকে আটকে রাখা যাবে। হয়ে গেলেন ‘সিকিউরিটি প্রিজনার’।
শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গ্রেফতার করে জেলবন্দি করার ফলে শাসকের সামনে আর এক সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রথমত পর্যাপ্ত জায়গার অভাব। আলিপুর ও অন্য বড় জেলগুলোতে সাধারণত দাগি আসামিদের সঙ্গে এঁদের রাখতে হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, এই বন্দিদের কোনও পূর্ব অপরাধের রেকর্ড ছিল না। বন্দি এবং সমাজের মধ্যে এই বিষয় নিয়ে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাই ‘সিকিউরিটি প্রিজনার’ রাখার জন্য ১৯৩১ সালে ইংরেজ সরকার আলাদা তিনটি ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করে। বহরমপুর , বক্সাদুয়ার এবং খড়গপুর রেল জংশনের কাছে হিজলীতে তৈরি হয় তিনটি ক্যাম্প।