বিশেষ প্রতিবেদন: কলকাতা প্লাবিত হয়ে যাওয়া নিয়ে চারিদিকে এখন হইচই কাণ্ড। ফেসবুকে হোয়াটস আপে ভরতি মিম। দুয়ারে জল, দুয়ারে সমুদ্র এসব নানাবিধ কথা লিখে। কিন্তু যদি বলা হয় ‘কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই’ অর্থাৎ এই ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত আড়াইশো বছর ধরে এভাবেই কলকাতার পথে চলছে নৌকা। সিরাজ, চার্নক সামলাতে পারেননি। পারেননি জ্যোতি-বুদ্ধ, পারছেন না মমতাও। তফাত একটাই যে এখন একটু বেশি বৃষ্টি হলেই রোজ বানভাসি হচ্ছে কলকাতা কিন্তু তখন বড় কোনও দুর্যোগ না হওয়া পর্যন্ত এমন অবস্থা হত না শহরের।
১৭৩৭ সাল, সেই বছরে যে ঝড়-জল হয়েছিল, তাতে কলকাতা শহরের অনেক ঘরবাড়ি ধ্বসে পড়ে গিয়েছিল। ‘ভাগীরথী’ থেকে ‘লবণ হ্রদ’ আজকের সল্টলেক পর্যন্ত ভেসে গিয়েছিল। বহু নৌকা নষ্ট হয়েছিল। এমন জল জমেছিল যে ‘ধর্মতলা’র পূব দিকের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ডিঙ্গাভাঙ্গা’। কিন্তু তা একদিন পরেই নেমে গিয়েছিল। আসলে, তখন বেশি বৃষ্টি হলে জল বেরিয়ে যেত ভাগীরথী কিংবা পূবের লবণ হ্রদে’। লবণ হ্রদ উপচে গেলে প্লাবিত হত শিয়ালদহ, বৈঠকখানা এলাকা।
১৭৫৬, ২১ জুন। ২০ জুন সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা শহর অবরুদ্ধ করেছেন। লড়াইয়ের নিহতদের মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল শহর কলকাতার নর্দমায়। ২১ জুন ভয়ঙ্কর বৃষ্টি, অতিবর্ষণের মৃতদেহ পচে কলকাতায় মহামারীর সৃষ্টি হয়েছিল। ১৮৬৪,৫ই অক্টোবরে ভয়ঙ্কর ঝড় বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল সেবারের ঝড়। শোনা যায় শ্যামবাজারের খাল থেকে নৌকা উড়তে উড়তে উল্টোডাঙ্গায় গিয়ে পড়েছিল।
১৮৮৭ সালের ২৫শে মে’তে বিশাল ঘূর্ণাবর্তের প্রভাবে ‘ভাগীরথী’তে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের দেখা দেয়। জলের জমার জেরে স্ত্র্যান্ড রোডে ডিঙ্গি বার করতে হয়েছিল।জল দ্রুতে নেমে গিয়েছিল। আজকের মতো একবার বৃষ্টি হলেই একঘেয়ে জল জমে থাকার অবস্থা হয়নি। সেই ঘূর্ণাবর্তের জলপথে কলকাতা থেকে পুরীতে রথযাত্রা দেখতে যাবার জন্য জাহাজ ছেড়েছিল। ‘স্যার জন লরেন্স’ নামের ‘ম্যাকলীন কোম্পানি’র সেই জাহাজে সবমিলিয়ে ১০০০ জন বালেশ্বরে’ যাচ্ছিলেন। জলোচ্ছ্বাসে জাহাজ ডুবি হয়ে সবাই মারা যান। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সিন্ধুতরঙ্গ কবিতা।
ভয়ঙ্কর অতিবর্ষণ হয়েছিল ১৯০০ সালে। সেবারে টানা সাতদিন ধরে বিপুল বৃষ্টিপাত হয়। বাঙলার সব নদীনালা ভেসে গিয়েছিল। কলকাতায় জলে প্রায় ডুবে যায় যায়। হল না। জল বেরিয়ে গিয়েছিল। ১৯২৫ সালের বর্ষাকালেও এক রাত্রে কলকাতায় অতিবর্ষণে সমস্ত বাড়ির নীচের তলা জলে ভেসে গিয়েছিল। এরপর অতিবর্ষণ ঘটেছিল ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তারপরে ১৯৫৬, ১৯৫৯, ১৯৭০ ও ১৯৭৮ সালে। সমস্যা বেড়েছে গত বছর চল্লিশে। এর কারণ শহর বড় হয়েছে, জল বেরনোর রাস্তা ছোট হয়েছে। নলগুলির ময়লাচ্ছন্ন। তাই সহজেই বুজে যায়। যে জল বেরোয় তা সবটা ‘বাগজোলা খালে’ গিয়ে পড়ে। খালের অবস্থা খুবই করুণ। তা একটু বেশি বৃষ্টি হলেই বারবার জলমগ্ন হয়ে যায় কলকাতা।