বিশেষ প্রতিবেদন: ১৯৪৯ সালের ২৯ নভেম্বর। ম্যাচটা ছিল ম্যানচেস্টার সিটি ও বোল্টন ওয়ান্ডার্সের মধ্যে। ম্যাচ নিয়ে ছিল চরম উত্তেজনা। স্টেডিয়াম জুড়ে নিরাপত্তা দ্বিগুণ করা হয়েছিল। কারণ ম্যাচটা ছিলো ম্যানচেস্টার সিটির গোলকিপার বার্ট ট্রটম্যানের অভিষেক ম্যাচ। ম্যাচজুড়ে যাকে শুনতে হয়েছিল দুয়ো।
কারণটা সেদিনের এক পুলিশের মুখেই শোনা যাক -The number of Police was doubled that day.When the team came down the tunnel there was no cheering. There was just an odd silence.I could hear mutterings behind me. “There he is, the German fella. He flew their fighter plans.”
শুরুতেই বেশ কিছু সেভ করায় এই দুয়োটা কিছুটা বন্ধ হয়।তবে আ্যাওয়ে ম্যাচগুলোতে প্রতিদিনই দুয়ো শুনতে হয়েছিল। কারণটা জানতে হলে আপনাকে কিছুটা পেছনে যেতে হবে। বার্ট ছিলেন একজন নাৎসি। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি হিটলারের ইউথ সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। সোভিয়েতের সঙ্গে যুদ্ধে বীরত্বের কারণে জিতেছিলেন ৫ টি মেডেল। পরে আটক হলে ইংল্যান্ডের কিছু কারাগারে বন্দি জীবন কাটান। সেখানেও খেলেন ফুটবল। সেই জীবন কাটিয়ে স্থানীয় একটি ক্লাবে খেলার সময় অনেক সুনাম পান যার ফলে যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। একজন নাৎসিকে নিজেদের দলে মেনে নিতে পারেননি ইংল্যান্ডের এই ক্লাবের ফ্যানরাও। প্রিমিয়ার লিগের অন্যান্য দলের ফ্যানরাও তাঁকে মেনে নেয়নি।কারণ তিনি যে শত্রু দেশের কুখ্যাত হিটলার বাহিনীর যোদ্ধা।
তাই কোনও ইংলিশ ক্লাব ফ্যানের জন্যই তাকে মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। তাই তিনি সিটিতে যোগ দিতেই আছড়ে পড়েছিল প্রবল বিরোধিতা।
শুধু সহায়তা পেয়েছিলেন দলের। সেটাই ছিল অক্সিজেন। যা প্রাণ ভরে নিয়েছিলেন তিনি। প্রথম ম্যাচের আগে সিটি ক্যাপ্টেন ওয়েস্টউড ড্রেসিংরুমে বলেন- “There is no war in the team.We welcome you as any other member of the staff.Just make yourself at home and good luck. ”
সেই যে শুরু তিনি ক্লাবের হয়ে খেলেন ৫৪৫ টি ম্যাচ।অবদান রাখেন দলে আর হয়ে যান ক্লাবের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গোলকিপার।ইংলিশ ফুটবলে তৎকালীন সময়ে ছিলন সেরা গোলরক্ষক। গোলপোস্টে তিনি ছিলেন এক অভেদ্য দেয়াল।একাই জিতিয়ে দিয়েছেন অনেক ম্যাচ। আর ফ্যানদের ঘৃণা পরিণত হয় ভালোবাসায়।
তাঁর ক্লাবের প্রতি ভালোবাসার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো ১৯৫৬ সালের এফএ কাপ ফাইনাল। ম্যাচজুড়ে ভালো খেলছিলেন।৭৫ মিনিটে প্রতিপক্ষ বার্মিংহামের মার্পির শট আটকতে গিয়ে ঘটে দুর্ঘটনা। ব্যাথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মাঠ ছাড়তে হতো। কিন্তু তখন যে বদলির নিয়ম নেই। হয় খেলা ছাড়ো নয়তো এভাবেই খেলে যাও। তিনি খেলে যান। ইনজুরি নিয়েই দলকে জেতান। পরে এক্স-রে রিপোর্টে দেখা যায় তার ঘাড় ভেঙে যায় যা মৃত্যুর কারণও হতে পারত। খেলা ছাড়েন ১৯৬৫ সালে।
যখন এসেছিলেন ফ্যানদের চোখে তিনি খুনি,আর যখন যাচ্ছিলেন তখন একজন মৃত্যুঞ্জয়ী কিংবদন্তি।যখন এসেছিলেন তখন ফ্যানদের হৃদয় ভরে ছিলো ঘৃণায় আর যখন যাচ্ছিলেন তখন তা পূর্ণ হয়েছিল ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায় তার শেষ ম্যাচে পুরো স্টেডিয়াম পূর্ণ ছিলো তাকে সম্মান জানানোর জন্য।ম্যাচ শেষ হওয়ার পর সিটি ফ্যানরা তার গোলপোস্ট ভেঙে ফেলে। কারণ তাদের মতে ওখানে দাড়ানোর অধিকার আর কারো নেই।যে মানুষটাকে তারা ক্লাবেই চাননি তাকে তারা এতটাই ভালোবেসেছিলেন।
ঘৃণিত ও নিন্দিত একজন মানুষ থেকে যেভাবে বার্ট নন্দিত ও অমর একজন ব্যাক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তা ফুটবলেরই এক রুপকথা।
প্রথম গোলকিপার ও বিদেশী খেলোয়াড় হিসেবে ইংলিশ ফুটবলে জেতেন ‘FWA award’। সঙ্গে আছে ‘OBE award’।কতটা অসাধারণ ছিলেন বার্ট? লেভ ইয়াসিনই বলেছিলেন
“There have been only two world-class goalkeepers. One was Lev Yasin and the other was the German boy who played for Manchester City.”
উল্লেখ্য ট্রটম্যানের এই অসাধারণ কাহিনী নিয়ে ‘The Keeper’ ছবিটি তৈরি হয়। ট্রটম্যানকে অনেকেই যতটা না একজন গ্রেট গোলকিপার হিসেবে মনে রেখেছে তার থেকেও বেশি মনে রেখেছে যুদ্ধে নাৎসি বাহিনি যা করেছে তা ভুল ছিল স্বীকার করার জন্য।ট্রটম্যানের প্রথম ১০০০ জনের ব্যাটেলিয়ন এর মাঝে মাত্র ৯০ জন বেঁচে ছিলেন তখন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনেকের মতো ট্রটম্যানকেও আনস্টেবল করে দিয়েছিল। প্রায়ই প্রচন্ড রেগে যেতেন ট্রটম্যান। পরে জানা গিয়েছিল যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে থাকা অবস্থায় যত নিষ্ঠুরতা দেখেছেন তা আটকাতে না পারার অনুশোচনা সারাজীবন তাকে তাড়া করেছে। ট্রটম্যানের জেনারেশনের বেশিরভাগ জার্মানই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কথা এড়িয়ে চলত। যেসব নির্মমতা তারা যুদ্ধে দেখেছে তা ভুলে থাকার চেষ্টা করত। অবশ্য ট্রটম্যান এখানে ব্যাতিক্রম।
ট্রটম্যান এবং তার একজন সহযোদ্ধা গোপনে একটা গনহত্যা দেখেছিলেন। যেখানে একটা গ্রামের সবাইকে একটা জঙ্গলে নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে নাৎসি বাহিনী। ট্রটম্যান আর তার সহযোদ্ধা কোনোরকমে পালিয়ে আসেন সেই জঙ্গল থেকে কারন যেকোনো প্রত্যক্ষদর্শীকে হত্যা করার অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। তিনি এটাও বলেছিলেন যে আরেকটু বড় হয়ে যদি এই নির্মমতা দেখতেন তাহলে তাঁকে সুইসাইড করতে হত। ট্রটম্যানের জেনারেশনের আর কোনও জার্মান নিজেদের ভুল স্বীকার করেন নি। এতটা সাহসিকতার পরিচয় খুব কম মানুষই দিতে পেরেছে।
একজন নাৎসি হওয়া, ফ্রন্টলাইনে থেকে যুদ্ধের নির্মমতা প্রত্যক্ষ করা, ফুটবল ক্যারিয়ার শেষে শান্তির জন্য কাজ করে যাওয়ার জন্য ট্রটম্যান প্রশংসিত হওয়ার মাঝে তিনি যে একজন গ্রেট কিপার ছিলেন এটা অনেকটাই চাপা পরে যায়। ক্যারিয়ারে ট্রটম্যানের ৬০% সেভ করার রেকর্ড হয়তো যথেষ্ট না ট্রটম্যানের গ্রেটনেস বোঝানোর জন্য। শট স্টপিং ছাড়াও ট্রটম্যান দ্রুত বল ডিস্ট্রিবিউট করে কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করতেন। বর্তমান আমলে এটা ডালভাত হলেও ৭০ বছর আগে কিপারদের নিয়মই ছিল শট স্টপ করার পরে বল ক্লিয়ার করা। এই প্রথা ভাঙেন কিংবদন্তি গোলকিপার লেভ ইয়াসিন। ইয়াসিন ছাড়াও হাঙ্গেরির গোলকিপার গ্রোসিকস এবং তাকে দেখে ট্রটম্যান ও কাউন্টার অ্যাটাকে সাহায্য করা শুরু করেন। তখন এটা যথেষ্ট বিষ্ময়কর ছিল।
ট্রটম্যানের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অপুর্নতা হল ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল না খেলতে পারা। নিজস্ব লীগে না খেললে জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া হবে না এই নিয়মের জন্য জার্মানির জার্সি পরার সুযোগ হয়নি ট্রটম্যানের। শালকে একবার ট্রটম্যানের জন্য বিড করলেও সিটি সেই অফার ফিরিয়ে দেয়। জার্মানির হয়ে না খেলার জন্য হোক বা অন্য কারনে জার্মানিতে ট্রটম্যানের তেমন পরিচিতি নেই।